বরিশালে ত্রাণ বিতরণে নানা অনিয়ম
বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ বিতরন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া জেলার প্রতন্ত অঞ্চলের অনেক দরিদ্র মানুষ ত্রাণ পাননি বলেও অভিযোগ করেছন। পাশাপাশি কিছু এলাকায় ত্রাণের তালিকা তৈরীতে স্বজনপ্রীতি এবং ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে।
বরিশাল নগরীর এক নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া এলাকায় বিএনপি করেন এমন অপবাদে কয়েকশ কর্মহীন দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি ত্রাণের দাবিতে তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা ত্রাণ পান।
নগরীর এক নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, পশ্চিম কাউনিয়া এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ারের বাড়ি। এ কারণে একটি মহল মনে করেন এ এলকায় যারা থাকেন তারা সবাই বিএনপি করেন। এমন অপবাদে ওই এলাকার অনেককে ত্রাণ দেয়া হয়নি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরন করা হয়।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমির হোসেন বলেন, এক নম্বর ওয়ার্ডে দরিদ্রের সংখ্যা বেশি। প্রথম পর্যায়ে যে পরিমাণ ত্রাণ এসেছিল তা দিয়ে সকলকে দেওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।
বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের চার জন দিন মজুরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মধ্যে দুই জন এ পর্যন্ত ৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু , ১ কেজি আলু ও ১ টি সাবান পেয়েছেন। অপর দুই জন এ পর্যন্ত কোন সাহায্য পাননি।
রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা দিনমজুর মো. মঞ্জু জানান, প্রতিবেশীর কাছ থেকে চাল ও ডাল ধার নিয়ে কয়েকদিন চলেছে। কিন্তু এখন ভবিষ্যৎ সংকটের আশায় কেউ ধারও দিচ্ছেন না।
তিনি আরও বলেন, ত্রাণের আশায় ইউনিয়ন পরিষদ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধর্না দিয়েছি। তবে ত্রাণ মেলেনি।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাদুরতলা গ্রামে এ পর্যন্ত ত্রান পৌছেনি। বাদুরতলা গ্রামের ৬৫০ টি পরিবারের মধ্যে ৫৫০ টি পরিবারই হতদরিদ্র।
খাঞ্জাপুর ইউনিয়নে পরিষদ চেয়ারম্যান ও গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নুর আলম সেরনিয়াবাত জানান, বাদুরতলা গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর ও ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত। তাদের অনেকের ঘরেই খাবার নেই। ত্রাণের স্বল্পতার কারণে ওই গ্রামে খাদ্য সহায়তা দেয়া যায় নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এদিকে গৌরনদী উপজেলায় মোট বরাদ্দ চালের পরিমাণ ১০৮ মেট্রিক টন। তবে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৩৫ মেট্রিক টন। কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩৫ মেট্রিক টনের কথা বলা হলেও ইউনিয়নে বিতরণের জন্য চাল পেয়েছেন ৯ টন।
উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হাফিজ মৃধা জানান, তার ইউনিয়নে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে এ পর্যন্ত মাত্র ১৩০ টি পরিবারকে সহায়তা করতে পেরেছেন।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উপজেলা প্রকল্প অফিস থেকে সাড়ে ৭ টন চালের বরাদ্দ পত্রে স্বাক্ষর নেয়া হলেও তার থেকে অনেক কম চাল বিতরণের জন্য পেয়েছি।
এদিকে উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ চাল কালোবাজারির দায়ে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির তালিকাভুক্ত ডিলার প্রদীপ দত্তকে (৪৫) ছয় মাস কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অপরদিকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আন্দারমানিক ইউনিয়নে ত্রাণ ও জেলেদের প্রণোদনার চাল কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে পার্শবর্তী মুলাদী উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবু হাসানাত জাপানের বিরুদ্ধে।
তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে বরিশালের হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচএম ফারুকুল ইসলামের শ্যালকের বাড়ি থেকে হতদরিদ্রের ৫৩০ কেজি চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় শ্যালক মো. ইউনুস সরদারকে (৩২) তিন মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদালত।
এছাড়া হিজলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে কেউ ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য ও কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূরে আলমের বাড়ি থেকে হতদরিদ্র জেলেদের ১৮৪ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এছাড়া হতদরিদ্র জেলেদের চাল ওজনে কম দেওয়ার দায়ে দুই ইউপি সদস্যকে ১ মাস করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউসুফ আলীর গুদাম থেকে কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্পের ৭ হাজার ৬৮০ কেজি চাল জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইউসুফ আলীকে ৬ মাস কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহাকরী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে) সুব্রত কুমার বিশ্বাস জানান, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত ২৫৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। এ পর্যন্ত (শনিবার) জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় জেলার ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ হতদরিদ্র ও কর্মহীন পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে হতদরিদ্র ও কর্মহীন সকল পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌছে দেয়া হবে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস জানান, দু'একটি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
ঢালাও ভাবে এধরনের অভিযোগ করা ঠিক হবে না। করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ বিতরণে কেউ অনিয়ম করলে ছাড় দেয়া হবে না। যাদের বিরুদ্ধে ত্রাণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হবে ,তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।