বছরের পর বছর ধরে পরে আছে লাশ, ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে ফ্রিজার সংকট
আমেরিকান নাগরিক রবার্ট মায়রন বার্কার ২০১৮ সালের ২৫ মে স্ট্রোকে মারা যান। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) তার ময়নাতদন্ত হয়। সেই থেকে তার মরদেহ মর্গেই আছে। আড়াই বছরেও বার্কারের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করতে পারেনি পুলিশ। বার্কারের মৃত্যুর পর দক্ষিণখান থানায় জিডি হয়।
থানার ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন টিবিএসকে বলেন, তৎকালীন ওসি আমেরিকায় বার্কারের তিন ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত আসেননি।
বার্কারের বাংলাদেশি স্ত্রী মাজেদা বেগম তার স্বামীর লাশ শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে মার্কিন দূতাবাসে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাননি। মাজেদা বেগম জানান, এ বিষয়ে তিনি এখন আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছেন।
প্রায় একই ধরনের জটিলতায় আরও তিনটি মরদেহ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে ঢাকা মেডিক্যালের ফ্রিজারে।
মৃত্যুর পর ছয় বছরের বেশি সময় ধরে খোকন ওরফে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী ওরফে রাজীব চৌধুরীর লাশ ঢামেক মর্গের পড়ে আছে। দুই ধর্মের দুই স্ত্রী স্বামীর লাশের দাবিদার।
লাশ হস্তান্তর নিয়ে জটিলতায় খোকন কোন ধর্মের ছিলেন ছিলেন তা জানতে আদালতে মামলা হয়। মামলা এখনো বিচারাধীন। আদালত সিদ্ধান্ত দিলে দুই স্ত্রীর একজনের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হবে।
খোকনের প্রথম স্ত্রীর নাম মীরা নন্দী ও ছেলে বাবলু নন্দী। ১৯৮০ সালে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে খোকন হাবিবা আকতার খানম নামে একজনকে বিয়ে করেন।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবিপুর গ্রামের হাসানুজ্জামান রিপন কাজের সন্ধানে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে বিয়ে করেন সেদেশের তরুণী থিইসিয়া সিকেওয়েস্টকে। থিইসিয়া স্বামীর সঙ্গে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে আসেন। একমাত্র ছেলের ভিনদেশি বউকে মেনে নেননি রিপনের বাবা-মা। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন থিইসিয়া। সেই থেকে মরদেহটি ঢামেক মর্গের হিমাগারে পড়ে আছে।
ভারতীয় নাগরিক মানিকাণ্ডার লাশ ঢামেক মর্গের ফ্রিজারে রয়েছে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে। কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।
পাঁচ ফ্রিজারের দুটি বিকল, মৃতদেহ সংরক্ষণে জটিলতা
ঢামেক হাসপাতালের মর্গের পাঁচটি ফ্রিজারে মরদেহ সরংক্ষণ করা যায় ২০টি। ফ্রিজারগুলোর মধ্যে দুটি বিকল হয়ে আছে বছর খানেক ধরে। একটি ফ্রিজারে আছে এই চার বিদেশির মরদেহ।
এ অবস্থায় দেশের সবচেয়ে বড় ফরেনসিক মর্গে এখন দুটি ফ্রিজারই ভরসা। এর মধ্যে একটি আবার মাঝেমধ্যেই বিকল হয়ে যায়। ফলে বেশিরভাগ সময় একটি ফ্রিজার দিয়েই কাজ চালাতে হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, এতে মৃতদেহ সংরক্ষণে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
মর্গের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্রিজার সমস্যার কারণে অনেক সময় মরদেহ মেঝেতে কিংবা স্ট্রেচারে ফেলে রাখতে হয়। তাতে মরদেহে পচন ধরে। মর্গের ভেতরে পচাগলা গন্ধে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মর্গে গড়ে দিনে পোস্টমর্টেমের জন্য ৮টির মতো মরদেহ আসে। ফ্রিজার সংকটের কারণে অনেক সময় মরদেহ বাইরে রাখতে হয়। তাতে পচন ধরে যাওয়ায় আলামত নষ্ট হয়ে যায়। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করাটা তখন কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে, মর্গের ৪টি এসি প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিকল। এগুলো ঠিক করার জন্য বারবার চিঠি দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
এ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, 'ফ্রিজারে সমস্যা দেখা দিলে আমরা ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারকে জানাই। তারা এসে ঠিক করে দেয়। তাদেরকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি, শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা নতুন ফ্রিজার কেনার জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি। অর্থ বরাদ্দ পেলেই ফ্রিজার কেনা হবে। আর অর্থ তো আমরা চাইলেই সাথে সাথে পাই না। এই বিষয়টাও বুঝতে হবে।'