ফোন ডিরেক্টরি বিক্রি করা যখন অপরাধ

বিশ্বাস করুন বা না করুন, ব্যবসায়িক ফোন ডিরেক্টরি বিক্রি করতে চাইলে আপনাকে জেলের ভাত খেতে হতে পারে! অন্তত, পল্টনের পুরাতন বই ও ম্যাগাজিন বিক্রেতা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাই হয়েছে।
পুলিশ বলছে দেলোয়ার একজন অপরাধী। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য দাবিকারী চাঁদাবাজ দলের কাছে সে ফোন ডিরেক্টরি সরবরাহ করত। চাঁদাবাজিতে সহযোগিতার অপরাধে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের দাবি, দেলোয়ার নির্দোষ।
দেলোয়ারের স্ত্রী জানান, পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ছিলেন তার স্বামী। এখন তিনি জেলে থাকায় পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। অর্থাভাবে আইনি সহায়তাও তারা নিতে পারছেন না বলে জানান তার স্ত্রী।
তিনি আরও জানান, দেলোয়ার দিনে এক হাজার টাকা বিক্রি করতে পারলে ২০০-৩০০ টাকা লাভ হত। সেই টাকাতেই নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট টিনশেড ঘরে চলত পাঁচ সদস্যের পরিবার।
স্ত্রীর মতো সঙ্গী বিক্রেতারাও জানে না পুলিশ কেন দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে।
"আমি জানি না কেন আমার স্বামীকে পুলিশ আটক করেছে। আমার নবজাতক একটা বাচ্চা আছে, আমার শ্বাশুড়িও অসুস্থ। প্রতি সপ্তাহে তার এক হাজার টাকার ওষুধ কেনা লাগে," বলেন দেলোয়ারের স্ত্রী।
"আমরা এখন দিনে তিনবেলা খেতেও পারি না। গত সপ্তাহে অন্য বই বিক্রেতারা মিলে কিছু টাকা তুলে আমাদের দেয়। আমি জানি না এরপর কী করব," কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার এবং স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি দল গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেলোয়ারসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ বলছে, দেলোয়ার এবং বাকি পাঁচজন সেভেন স্টার গ্রুপ নামে ঢাকার এক আন্ডারওয়ার্ল্ড দলের পরিচয় দিয়ে ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায় করে থাকে। সুব্রত বাইন, মোল্লাহ মাসুদ এবং মুরগী মিলনের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড দলটি গঠিত।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী তারা বিভিন্ন উৎস থেকে তারকা এবং ব্যবসায়ীদের নাম্বার সংগ্রহ করে চাঁদা দাবী করত। এমনই এক ব্যবসায়ীর দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১৬ জানুয়ারি ডিএমপির অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মুহাম্মদ ওয়ালিদ হোসাইন গণমাধ্যমের কাছে এক ব্রিফিং-এ জানান, চাঁদাবাজদের তিনটি দল সক্রিয়। প্রথম দল নীলক্ষেতের মতো ঢাকার পুরান বইয়ের দোকান থেকে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে থাকে। দ্বিতীয় দলটি টার্গেটকৃতদের ফোন করত এবং তৃতীয় দলটির কাজ ছিল মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে চাঁদার অর্থ সংগ্রহ করা।
তবে মামলার বাদী মোহাম্মদ আলমগীর হোসাইন বলেন তিনি দেলোয়ারকে চিনেন না।
"যে তিনজন কলার ফোন করে চাঁদা দাবী করেছিল আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। দেলোয়ার কে? আমি তাকে চিনি না," জানান আলমগীর হোসাইন।
দেলোয়ার যেখানে বই বিক্রি করত বুধবার প্রতিবেদক সেখানে যায়। অন্য বিক্রেতারা জানান, দেলোয়ার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বই বিক্রি করছে। তাদের দাবি, দেলোয়ার খুব সাধারণ মানুষ ছিল। সে কখনো কোন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
বই বিক্রেতা হানিফ ২৪ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে বই বিক্রি করেন। তিনি জানান, "আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করি। আমি শুনেছি দেলোয়ার এক ব্যবসায়িক ডিরেক্টরি বই বেচেছিল যেটা ভুল হাতে গিয়ে পড়েছে।"
"আমরা তাকে বহু বছর ধরে চিনি। কোনো চাঁদাবাজ দলের সাথে জড়িত থাকা তার জন্য অসম্ভব। পুলিশ তাকে ভুল ভাবে ফাঁসিয়েছে," জানান তিনি।
আব্দুর রহিম নামের আরেক বিক্রেতা ১৬ বছর ধরে বই বিক্রি করছেন। তিনি জানান, "আমরা শুধু পুরান বই কিনি আর বিক্রি করি। ফোন ডিরেক্টরির ভিতরে কী আছে আমরা সেটাও জানি না। এখানে অধিকাংশ বিক্রেতারাই অশিক্ষিত।"
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে দেলোয়ারের প্রতিবেশি তাজুল ইসলাম জানান, তিনি দেলোয়ারকে ছোটবেলা থেকে চিনেন।
"সে গরীব। কিন্তু সৎ একজন মানুষ। তাকে গ্রেপ্তারের পর থেকে আমরা তার পরিবারকে সহায়তা করছি। কিন্তু মানুষ আর কতদিন করবে?" জিজ্ঞেস করেন তিনি।
মহামারির আগে দেলোয়ার পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভাগাভাগি করে একটি ঘরে থাকত। লকডাউনে ব্যবসা ধসে পড়লে সে নারায়ণগঞ্জ চলে যায়। দোকান খোলার পর, নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হত।
বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আবুল হাশেম কবির জানায়, দেলোয়ারকে গ্রেপ্তারের পর ইউনিয়নের সদস্যরা পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে গিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ তাদের প্রবেশের অনুমতি দেয়নি।
"দেলোয়ারকে ভুলবশত আটক করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার কথা জানায় গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু এরপর তাকে সরাসরি জেলে পাঠানো হয়," বলেন তিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পুলিশ দেলোয়ারকে সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করেছে।
"চাঁদাবাজ দলের সদস্যরা দেলোয়ারের কাছ থেকে ডিরেক্টরি সংগ্রহ করত। তবে, আমরা এখন পর্যন্ত তার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। তদন্তের কাজ এখনো চলছে," জানান তিনি।
অন্যদিকে, দেলোয়ারের আইনজীবী আলাউদ্দীন আল আজাদ জানান, তার মক্কেল নির্দোষ।
"পুলিশ তাকে অযথাই হয়রানি করছে। চাঁদাবাজ দলের সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকার কথা সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া দেলোয়ারের উপর নির্দিষ্ট কোনো চার্জ আরোপ করা হয়নি," জানান আইনজীবী।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: When selling business directories is a crime