ফিরে আসছে দেশি মাছ
বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধারে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর গবেষকরা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক গবেষণায় ২৩ প্রজাতির মাছের পোণা উৎপাদন এবং চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনে সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা।
এগুলো হচ্ছে পাবদা, গুলশা, গুজিআইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, টেংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বেড়ালী, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালিবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি ও গণিমাছ।
বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলোর জাত সংরক্ষণের বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা ইয়াসমিন জানান, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যে মাছগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে সেগুলো সংরক্ষণ করে কৃত্রিম প্রজণনের মাধ্যমে পোণা উৎপাদনের পর জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করার গবেষণা করছেন তারা।
তিনি জানান- ঢেলা, শালবাইন,কাকিলা ও আঙ্গুস ভোল মাছের প্রজণন ও চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়েও গবেষণা চলছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, ময়মনসিংহে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর এবং যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে কাজ চলছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের পুনরুৎপাদনের জন্য গবেষণা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই জিন সংরক্ষণ, প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ পদ্ধতির উপায় জানা সম্ভব হয়েছে।
৩০০ কোটি দেশীয় মাছ সারা দেশে সরবরাহ
তিনি বলেন, মাঠপর্যায়েও এই মাছের পোণা বিতরণ করা হয়েছে। যা বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে। প্রতিবছর বিএফআরআই সহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে প্রায় ৩০০ কোটি দেশীয় মাছের পোণা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে বাণিজ্যিকভাবে এসব মাছ চাষ করা যাচ্ছে। এতে মাছের প্রজাতি ফিরে আসার পাশাপাশি উৎপাদন বেড়ে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা। এই খাতে বিনিয়োগও বাড়ছে, সামনে আরো বাড়বে।
ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়া উপজেলার স্বর্ণালী হ্যাচারির মালিক আবদুল কাদের জানান, তিনি দেশীয় জাতের রেনু উৎপাদন করেন। তার উৎপাদিত রেনু ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় যায়। পাবদা, গুলশা ও শিং মাছের প্রতি চাষিদের আগ্রহ বেশি।
তিনি জানান, প্রকুরের পাশাপাশি বায়োফ্লক্স ও আরএএস পদ্ধতিতে চৌবাচ্চায় যেসব মাছ চাষ হয় সেখানে দেশীয় ছোট মাছের পোনার চাহিদা বেশি।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার মাছ চাষি মতিউ রহমান সেলিম জানান, তিনি প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে শিং মাছের দুই কেজি রেনু চাষ করে যেখান থেকে তিন মাসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পোনা উৎপাদন করেন। সেই পোনা চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিবারে দুই লাখ টাকা খরচ করে তার লাভ হয় দেড় লাখ টাকা।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বইলর মঠবাড়ি গ্রামের প্রায় আশি বছর বয়সি কৃষক খোকা মিয়া। ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার নেশা তার। এ নেশায় সারাজীবন খাল-বিল, নদী-নালা চরে বেড়িয়েছেন তিনি। দেশি মাছ নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
মেনি, ফলি, রানী এমন সব নামের মাছের প্রজাতির কথা বললেন তিনি। এসব মাছ ধরা ও খাওয়ার তৃপ্তির ঢেকুর এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। বললেন, এখনকার প্রজন্ম এসব মাছের নামই জানে না। অথচ এমন সময় ছিল যখন এসব মাছ ধরা ও খাওয়ার স্বাদ পেতে পায়ে হেটে মাইলের পর মাইল পারি দিয়ে গিয়েছি খাল বিলে।
জানালেন এখনও বরশি দিয়ে মাছ ধরেন তিনি। তবে আগের মতো বাহারি স্বাদের মাছ পাওয়া যায় না। খাল বিলে আগের মতো মাছ নেই আর।
চাহিদা ও লাভ বেশী
ত্রিশাল উপজেলার কাকচর গ্রামের মাছ চাষী আপেল মাহমুদ বলেন, দেশি মাছের চাহিদা বেশি, দামও ভালো পাওয়া যায়। তাই অন্যান্য মাছের পাশাপাশি দেশীয় মাছ চাষ করেন। ৩০ লাখ টাকা খাটিয়ে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি।
এ বিষয়ে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, দেশি মাছ ফিরে আসবে, আগের চেয়ে আরো বেশি আসবে। এসব মাছের কৃত্তিম প্রজননে যাচ্ছি আমরা। তাই উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ সব মাছের আগের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন গবেষকরা। আমরা চাচ্ছি এসব দেশী ছোট মাছ যেন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা যায়।
মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে দেশীয় মাছের লাইভ জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি ছোট দেশীয় প্রজাতির মাছ, এদের মধ্যে ৬৪টি মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এরই মধ্যে বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ছে।
দেশীয় মাছ সুরক্ষায় বর্তমান সরকার মৎস্যবান্ধব বিভিন্ন নীতি গ্রহন করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে দেশে পুকুরে দেশীয় ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিলো ৬৭ হাজার ৩৪০ টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২.৪১ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
তিনি আরো জানান, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাওর, বিল ও নদ নদীতে অধিক সংখ্যক অভয়াশ্রম করা হয়েছে ও এসব মাছের পোনা অবমুক্ত করা হচ্ছে। অচিরেই দেশের সাধারন মানুষের পাতে দেশি ছোট মাছের প্রজাতির সংখা বাড়বে।যা থাকবে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে।