পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বেড়েছে ছিনতাই, আতঙ্কে পর্যটক এবং বিদেশিরা
দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ছিনতাই বাড়ছে। পর্যটন স্পটগুলো ছাড়াও শহরের প্রধান সড়ক, এমনকি অলিগলিতেও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন পর্যটক ও পথচারীরা। স্থানীয় থানা পুলিশের হিসেবে, তিন বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭ গুণ। বছর বছর ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কতর্ব্যরত কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার তথ্যমতে, কক্সবাজার শহরে ২০১৯ সালে ছিনতাইয়ের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে মাত্র ৮টি। ২০২০ সালে প্রায় চার গুণ (২৬২ দশমিক ৫ শতাংশ) বেড়ে ছিনতাইয়ের অভিযোগ দাঁড়ায় ২৯টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে ৩৩টি। অথচ গত বছর (২০২০ সাল) একই সময়ে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মাত্র ১২টি। ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি বছরে ছিনতাই ৩১২ দশমিক পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। সদর মডেল থানা এলাকায় তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীর সংখ্যা ১১৭ জন।
গত ১১ জুন সকালে টেকপাড়ায় ছিনতাইয়ের শিকার হন কক্সবাজার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহজাহানের পুত্রবধু। মেয়েকে প্রাইভেটে দিয়ে আসার সময় টেকপাড়া এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। তার কাছে থাকা মোবাইল ও গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন কেড়ে নেন ছিনতাইকারীরা।
এর আগে ২ জুন শহরের রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এ্যাডভোকেট পারভীন সুলতানা। অফিসে যাওয়ার সময় রহমানিয়া মাদ্রাসা সড়কে সিকদার বাড়ির সামনে তার উপর হামলা চালিয়ে মোবাইল ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।
স্থানীয়দের মতে, শহরের প্রধান সড়কের কালুর দোকানের কচ্ছপিয়া পুকুরপাড় থেকে লাইট হাউস সড়ক, আলীর জাঁহাল এসএম পাড়া সড়ক, হাশেমিয়া মাদ্রাসাস্থ রাস্তার দুপাশের এলাকা, রুমালিয়ারছড়া থেকে দুই বিপরীতমুখী সড়ক দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া ও উত্তর রুমালিয়ারছড়া, তারাবনিয়ারছড়া, পুরাতন কমার্স কলেজ সড়ক, টেকপাড়া, বাহারছড়া চত্বর থেকে বাহারছড়া বাজার, মোহাজের পাড়া, গোলদিঘীর পাড়স্থ বৈদ্যঘোনা, ঘোনাপাড়া, খাঁজা মঞ্জিল প্রভৃতি সড়কে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু সড়কে বাতি থাকলেও বেশিরভাগ অকেজো। সড়কগুলো রাতে অন্ধকারে ডুবে থাকে। ওই সড়কসমূহে প্রতিদিন চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাই থেকে রেহাই মিলছে না নারীদেরও।
কক্সবাজার শহরে প্রতি বছর প্রায় কোটি পর্যটকের আগমন ঘটে। এছাড়া শতাধিক আন্তর্জাতিক ও দেশীয় দাতব্য সংস্থায় কর্মরত প্রায় এক হাজার বিদেশি অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। নিরাপত্তার লক্ষ্যে শহর এলাকায় ৬৪টি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছে পুলিশ। কিন্তু এসব সিসিটিভির বেশিরভাগই অকেজো হয়ে বন্ধ হয়ে আছে।
পর্যটন ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের মতে, সকল ছিনতাইয়ের ঘটনা পুলিশের রের্কডভুক্ত হয় না। এখানে সারাদেশ থেকে পর্যটকরা আসেন। ছিনতাইয়ে মোবাইল কিংবা নগদ অর্থ খোয়া গেলেও পুলিশি ঝামেলায় যেতে চান না অনেকে। ফলে থানায় রেকর্ড হওয়া অভিযোগের চেয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা কমপক্ষে তিনগুণ বেশি বলে মন্তব্য পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের।
করোনা মহামারির কারণে দুই বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ ছিল পর্যটন খাত। এতে পর্যটনকে ঘিরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। ফলে এসব পেশার মানুষ ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে মত সমাজবিজ্ঞানীর।
ওপেন ওশান হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আয়াজ মাহমুদ বলেন, শহরের জেল্ল্যার দোকান থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত এলাকায় বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি।
দি সি প্রিন্সেস হোটেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল বশর চৌধুরী জানান, গত দুই-তিন বছর ধরে ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের শিকার হয় পর্যটকরা। কারণ দুই-এক দিনের জন্য ঘুরতে আসা পর্যটকদের জানা থাকে না কোন এলাকায় বেশি ছিনতাই হয়। ফলে রাতে ঘুরতে বের হয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে পর্যটকরা। এসব ঘটনার বেশিরভাগই থানা পর্যন্ত পৌঁছে না। যা ছিনতাই হয় তার মাত্র এক-চতুর্থাংশ হয়তো রেকর্ড হয়।
কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনিরুল গিয়াস বলেন, 'করোনা মহামারির কারণে পর্যটন খাতের ব্যবসা বন্ধ থাকায় কয়েকটি পেশার মানুষ ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। ছিনতাই ও চুরির ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের এমন দেড় শতাধিক তরুণকে গত এক বছরের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে শতাধিক তরুণকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি ছিনতাইয়ের ঘটনা কমিয়ে আনতে'।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'পর্যটনকে ঘিরে বিভিন্ন পেশায় জড়িত থাকা মানুষগুলো করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে বেকার ছিল। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকা বিদেশিদের টার্গেট করে ছিনতাই হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক। কারণ এসব ঘটনা আমাদের সমাজ সম্পর্কে তাদের কাছে খারাপ বার্তা পৌঁছাবে'। ছিনতাই প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।