দুদকের ভুল তদন্তে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা বাতিল

'দেশে কোভিড-১৯ এর প্রভাব শুরু হলে গত বছরের এপ্রিল মাসে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য উঠে পড়ে লাগে। জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে এসএসসির সনদ জালিয়াতির মামলায় ১৫ বছরের সাজা রয়েছে। আমি এরপর থেকে পলাতক থাকি। এরপর আইনজীবীর পরামর্শে হাইকোর্টে রিট করি। উচ্চাদালত রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার যে রায় দিয়েছেন, তা আমার জীবনের জন্য বড় পাওয়া। এছাড়া আজ আমাকে বিনাদোষে জেলে থাকা লাগতো।' এভাবেই বলছিলেন এসএসসি পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির ঘটনায় নামের মিল থাকায় ১৫ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত নোয়াখালীর নিরপরাধ কামরুল।
বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভুল তদন্তের ওপর নিরাপরাধ যুবক কামরুলকে দেওয়া বিচারিক আদালতের ১৫ বছরের কারাদণ্ডের রায় বাতিল করেছেন।
একইসাথে দুর্নীতি দমন কমিশনকে এই মামলা পুনরায় তদন্ত করারও নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও এই মামলায় ভুলভাবে চার্জশীট দেওয়া দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাহফুজ ইকবালের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালত বলেছেন, নিরপরাধ কামরুল দুদকের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করলে সেটি বিবেচনা করবে। নিরপরাধ কামরুল এখন নোয়াখালী জেলা জজ আদালতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করেন।
নিরপরাধ কামরুলের আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দুদকের ভুল তদন্তের কারণে নিপরাধ কামরুল যতোটা ভোগান্তির শিকার হয়েছে, তার চেয়ে বড় ব্যাপার দুদকের মতো একটা বড় সংস্থা এভাবে ভুল তদন্ত করে একজন নিরপরাধ মানুষকে ফাসিয়েছে, যা নজিরবিহীন ঘটনা।
রিটের নথি থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রসিকিউটিং পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম একটি এজাহার দায়ের করেন। মামলায় বলা হয়, নোয়াখালী সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলাম নোয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫৭৬ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাসের জাল/ভুয়া মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র সৃজন/সংগ্রহ করে ১৯৮৯-৯৯ সেশনে মাইজদী পাবলিক কলেজে ভর্তি হন।
রিটে বলা হয়, কিন্তু মুলত এই অভিযোগ পশ্চিম রাজারামপুরের মো. আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। নিরাপরাধ কামরুল ১৯৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করে। ২০০৬ সালে হরিনারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। দরিদ্র্যের কারণে এইচএসসিতে ভর্তি হতে পারেননি।
রিটে বলা হয়, মামলাটির তদন্ত করেন দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মাহফুজ ইকবাল। পরে তিনি ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর চার্জশিট জমা দেন। যেখানে পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলামকেই অভিযুক্ত করা হয়।
মামলার বিচার শেষে নোয়াখালীর বিশেষ জজ শিরীন কবিতা আখতার ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। রায়ে কামরুল ইসলামকে জাল ডকুমেন্ট তৈরি, দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার ও কাছে রাখার দায়ে দন্ডবিধির তিনটি ধারায় মোট ১৫ বছরের কারামন্ড ও ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
নিরপরাধ কামরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিছুই জানতেন না। গত বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামঝি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তৎপর হলে বিষয়টি জানতে পারেন।
কামরুল বলেন, ২০০৮ সালের ৮ জুলাই এমএলএসএস হিসেবে লক্ষ্মীপুর আদালতে যোগ দেন। পরে নোয়াখালীতে বদলি হন। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে তিনি নোয়াখালী আদালতের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন।
গত বছর এ রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট ৫ নভেম্বর রুল জারি করেন এবং দুদকের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা চান। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রুলের জবাব দিয়ে দুদক ভুল স্বীকার করেন। দুদক গত ২৬ জানুয়ারি আদালতে বলেন, 'এটি সরল বিশ্বাসের ভুল (বোনাফাইড মিসটেক)'।