দুই বছর পর আবারও এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়ানোর শঙ্কা
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মারা যাচ্ছে পরিযায়ী পাখি, সারস, হাঁস-মুরগি ও কাক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে প্রতিবেশী দেশ থেকে এই রোগের সংক্রমণ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রানিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, গত ২০-২৫ দিন আগে ভারতের হিমাচল, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশসহ মোট ১১টি রাজ্যে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রাদুর্ভাব ছড়ায়। এজন্য ভারতসহ বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত দেশ থেকে মুরগির বাচ্চা, প্যারেন্ট স্টক, গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক, হাঁস-মুরগি, পাখি ও ডিম আমদানির অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
পোলট্রি খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে সাম্প্রতিক সময়ে খুব সামান্য পরিমাণে প্যারেন্ট স্টক আমদানি হয়েছে। তবে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চোরাই পথে কিছু প্যারেন্ট স্টক, একদিনের মুরগির বাচ্চা দেশে প্রবেশ করে। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবেই পরিযায়ী পাখির যাতায়াত রয়েছে। এ কারণে দেশেও এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য পোলট্রি সেক্টরে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন ব্যবহারে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বার্ড-ফ্লু রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ভারত থেকে পেরেন্ট স্টক ও গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে যেন কোনোভাবেই মুরগির মাংস, মুরগির বাচ্চা, প্যারেন্ট স্টক চোরাই পথে আসতে না পারে, সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত দেশ থেকে হাঁস-মুরগি, পাখি ও ডিম আমদানির কোনো অনুমতি দেয়নি। তবে ফ্রান্স, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, শ্রীলংকা, নেদারল্যান্ডস, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরি এবং নিউজিল্যান্ড থেকে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা নিয়মিত আমদানি করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। যেসব দেশে সংক্রমণ রয়েছে, সেখান থেকে কোনো ধরনের প্যারেন্ট স্টক, ডিম যেন না আসে তা মনিটরিং করা হচ্ছে। খামাড়িদেরকেও প্রশিক্ষণ প্রদান ও সতর্ক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
তবে দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী ভ্যাকসিন আমদানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সচিব।
ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিম্যাল হেলথ (ওআইই) বিশ্বব্যাপী প্রাণিসম্পদ খাতের রোগবালাই সংক্রমণের বিষয়ে নিয়মিত তথ্য ও সতর্কতা প্রদান করে। সেই সতর্কতা মেনে বিভিন্ন দেশ তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সতর্কবার্তায় (১৫ জানুয়ারি- ৪ ফেব্রুয়ারি) এশিয়ার মধ্যে চীন, হংকং, ভারত, ইরান, ইরাক, ইসরায়েল, জাপান, কোরিয়া, কুয়েত, নেপাল ও ভিয়েতনামকে সংক্রামক দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। রিপোর্টে এশিয়ায় পোলট্রি ও পোলট্রি খাতের বাইরে মোট ১৩৮টি নতুন সংক্রমণের তথ্য দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এই তালিকায় রয়েছে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, নরওয়ে, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাজ্য। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ভারত থেকে খুব একটা আমদানি না করলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্যারেন্ট স্টক ও গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক আমদানি করে। ইউরোপের দেশগুলোতে অবশ্য নতুন ৫০০ সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, দিল্লির কমার্শিয়াল কাউন্সিলর বাংলাদেশকে একটি চিঠি দিয়ে ভারতে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ার তথ্য জানায়।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ২০১৯ সালের পর থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েনি। তবে ২০০৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এই ভাইরাস বাংলাদেশের পোলট্রি খাতকে ভালোভাবেই ভুগিয়েছে। এ সময়ে ৫০৪টি বাণিজ্যিক পোলট্রির খামারে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ধরা পড়ে। তখন প্রায় ৩১ লাখ মুরগি এবং ৩২ লাখ ডিম ধ্বংস করা হয়। যার ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার ৮২২ জন খামারিকে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।
নতুন করে যেন এই খাতের ওপর ভাইরাসটির প্রভাব না পড়ে, সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে থাকতে চায় বাংলাদেশ। কারণ এটি ডিম ও মাংস উৎপাদনে বড় প্রতিবন্ধকতা।
মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের পর থেকে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ধরা পড়েনি। কিন্তু পোলট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনো কিছু কিছু সংক্রমণ রয়েছে, তা খুব ছোট পরিসরে। সম্প্রতি ভ্যাকসিন আমদানির অনুমোদন দেওয়ার কারণে এর প্রাদুর্ভাব কমে এসেছে।
সভায় মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে প্রায় ৩৬ কোটি ডোজ এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা একবার সংক্রমণটা ফেস করেছি। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। তবে এর সংক্রমণ একেবারেই নাই বলা যাবে না, যে কোনো সময় আবার আঘাত আসতে পারে। এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।'
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে সর্ভিল্যান্ড কর্মসূচি গ্রহণ করা, রোগ নির্ণয়ে গুরুত্ব দেওয়া, সন্দেহজনক হাঁস-মুরগি গবেষণাগারে পরীক্ষা করা, পোলট্রি ও পোলট্রিজাত পণ্যবাহী যানবাহনে জীবানুনাশক ছিটানো, হ্যাচারিতে একদিন বয়সী বাচ্চার টিকা নিশ্চিত করা এবং খামারগুলোতে মনিটরিং বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।