তাহলে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল কেন?
মে মাস। করোনার সংক্রমণ তুঙ্গে। সিলেট বিভাগে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত একশ' শয্যার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি রোগী। অন্য হাসপাতালগুলোও করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরুর উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রাথমিকভাবে নগরের নয়সাড়ক এলাকার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালকে বাছাইও করা হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয় অধিবাসীরা। তাদের এলাকার হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদান না করার দাবি জানান তারা।
এলাকাবাসীর এমন দাবিতে বিপাকে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েন রোগীরা। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। অন্য হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করছে না। এতে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে পথেই রোগী মারা যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে সিলেটে।
অথচ সিলেটেই রয়েছে সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসার জন্য আলাদা একটি হাসপাতাল। ১৯৬২ সালে 'সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল' নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ সংক্রামক রোগ কোভিড-১৯ মহামারি আকার ধারণ করার সময়ও কোনো কাজেই আসেনি এ হাসপাতাল। করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়নি সরকারি এই চিকিৎসা কেন্দ্র। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, 'তবে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের কাজ কী?'
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দীর্ঘ অবহেলা আর নানা সঙ্কটে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতলটি। নেই তেমন কোনো চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসকও। ফলে করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালটি ব্যবহার করা যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রথমে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল। তবে এখানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার আনুষঙ্গিক কোনো যন্ত্রপাতি না থাকা ও লোকবল সংকটে এই পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সিভিল সার্জন ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে থাকায় 'আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়' প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা হাসপাতালটি সংস্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৬২ সালে 'কলেরা হাসপাতাল' নামে ১০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ২০ শয্যার এই হাসপাতাল। পরে এটিকে 'সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল' হিসেবে নামকরণ করা হয়। সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য তৎকালীন সময়ে শহরের বাইরে নির্জন স্থানে নির্মাণ করা হয় এই হাসপাতাল।
প্রথমে হাসপাতালটি সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকির মাধ্যমে পরিচালিত হলেও বর্তমানে দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যাহত হচ্ছে সেবা কার্যক্রম। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও সিভিল সার্জনের মাধ্যমে এখন পরিচালিত হচ্ছে এটি।
এদিকে ৫৮ বছর আগে ২০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা না বাড়লেও কমেছে জায়গার পরিমাণ। প্রতিষ্ঠার সময় ১০ একর থাকলেও বর্তমানে মোট জায়গার পরিমাণ নেমে এসেছে মাত্র এক একর সাত শতকে।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ভূমি অধিগ্রহণের কারণে কমেছে জায়গা। এ ছাড়া হাসপাতালের চার শতক জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে সদর উপজেলা খেলার মাঠ, যা এখন শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। সংক্রামক হাসপাতালের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। প্রভাবশালী গোষ্ঠী হাসপাতালের অনেক জমি দখল করে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর হাসপাতালটিতে যুক্ত হয়েছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। এই অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া এখানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদানের তেমন কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। এমনকি নেই কোনো এক্স-রে মেশিনও। রয়েছে তীব্র জনবল সঙ্কট।
হাসপাতালে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৪৫। তবে মঞ্জুরীকৃত পদের ৬৩ শতাংশই শূন্য রয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে দুই চিকিৎসকসহ কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৭ জন।
এখানে একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট, একজন জুনিয়র কনসালটেনন্ট, দুইজন মেডিকেল অফিসার ও একজন প্যাথলজিস্ট থাকার কথা থাকলে শুধু মেডিকেল অফিসার পদে দুজন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন।
জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের চিকিৎসকের পদটিতে একজন কর্মরত থাকলেও, তিনি গাইনি বিভাগের চিকিৎসক হওয়ায় বর্তমানে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। হাসপাতালটিতে তিনটি মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদ থাকলেও তিনটিই খালি রয়েছে। খালি রয়েছে স্টুয়ার্ডের পদ। হাসপাতালে পাঁচটি সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের সবাই কর্মরত থাকলেও সহকারী স্টাফ নার্সের চারটি পদের তিনটিই খালি।
সঙ্কট রয়েছে প্রশাসনিক পদেও। একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ও ছয়জন অফিস সহায়ক (এমএলএসএস) থাকার কথা থাকলেও শুধু একজন অফিস সহায়ক দিয়ে চালানো হচ্ছে গোটা হাসপাতালের প্রশাসনিক কার্যক্রম। সঙ্কট আছে কর্মচারী পদেও।
হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে এখানে ডাইরিয়া, ধনুষ্টংকার, জলবসন্ত, জলাতঙ্ক, টিটেনাস, হাম, মামস-জাতীয় রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য এখানে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই বলে জানান তারা।
সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. এহসানুন জামান খান বলেন, হাসপাতালটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনবল ঘাটতি। একটি কনসাল্টেন্টের পদ থাকলেও সেটি খালি রয়েছে। এ ছাড়া নেই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার সুযোগ সুবিধা। হাসপাতালটিতে চারটি অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশন প্রতিস্থাপন জরুরি হলেও এ ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমানের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
হাসপাতালটির উপ পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, এখানে দ্বৈত প্রশাসন থাকার কারণে জনবল থেকে শুরু করে কোনো ব্যাপারে তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারপরও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে সম্প্রতি একটি অ্যাম্বুলেন্স ও চালক নিয়োগ দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'আমি সিভিল সার্জন থাকাকালীন সময়ে এ ব্যাপারটা নিয়ে উর্ধ্বতন মহলে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি এবং দুই-তিনবার চিঠি দিয়েছি। বর্তমানে, করোনাকালীন পরিস্থিতে এ হাসপাতালের প্রয়োজনীয় উন্নয়নে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে খুব দ্রুতই এটি একক প্রশাসনের আওতায় চলে আসবে। তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও সম্ভব হবে।'
স্বাস্থ্য অধিপ্তর, সিলেটের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, 'প্রথমে আমরা এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আইসিইউ, ভ্যান্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও লোকবল না থাকায় এটি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।'