তাণ্ডবে নিহত দুজন পুলিশের মামলার আসামি!
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের ঘটনায় নিহত দুজনকে পুলিশ বাদীর একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। আসাদুল্লাহ রাতিন (১৬) ও কামাল মিয়া (৩১) নামে ওই দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর পুলিশ মামলাটি দায়ের করে।
নিহতরা আসামি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
রাতিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের শফিকুল ইসলামের ছেলে ও কামাল মজলিশপুর ইউনিয়নের জালাল উদ্দিনের ছেলে। এদের মধ্যে রাতিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন আর কামাল তার গ্রামে রিকশা চালাতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন কামাল। এরপর ২৮ মার্চ সকালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। আর রাতিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান ২৯ মার্চ রাতে।
২৭ মার্চের সহিংসতার ঘটনায় ৩১ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সোহরাব হোসেন। ২১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলার এজহানামীয় আসামিদের মধ্যে ১০ নম্বরে কামালের নাম দেওয়া হয়েছে। এজহারে তার বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৩২ বছর। আর ১৫ নম্বর আসামি নামে রয়েছে রাতিনের নাম। এজহারে তার বয়স ২৫ বছর।
তবে এজাহারে তাদের দুজনের কারও বাবার নাম উল্লেখ করেননি বাদী। আর ঠিকানায় শুধু সুহিলপুর উল্লেখ করা হয়।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে আশরাফ আলী (২৮) নামে গ্রেপ্তার হওয়া এক আসামি গত ২৩ এপ্রিল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ শাহজাহান।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত নন্দনপুর বাজার ও আশপাশ এলাকায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয় জনতা রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রইছ উদ্দিন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন রেজা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নন্দনপুর বাসস্ট্যান্ডে গেলে বিক্ষোভাকারীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেলও নিক্ষেপ করে।
এ সময় পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা শর্টগানের ফাঁকা গুলি, সিসার গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে বিক্ষোভকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তখন রাস্তায় অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ। পরে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
নিহত কামালের মা হোসনা বেগম বলেন, '২৭ মার্চ বিকেলে কেউ একজন কামালকে ফোন করার পর সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মাগরিব নামাজের পর কামাল গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে আরেক আহত ব্যক্তি জানায়, পুলিশ কামালকে কুমিল্লায় নিয়ে গেছে। পরদিন ২৮ মার্চ সকালে কামাল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় বলে জানতে পারি। এরপর ২৯ মার্চ রাতে গ্রামের কবরস্থানে কামালের লাশ দাফন করা হয়।'
নিহত রাতিনের বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, '২৭ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মায়ের জন্য ওষুধ আনতে যায় রাতিন। এরপর আর সে বাড়ি ফিরেনি। হাসপাতাল ও থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও রাতিনকে পাইনি। শুনেছি সুহিলপুরে রাতিন গুলিবিদ্ধ হয়। পরে পুলিশ তাকে কুমিল্লায় নিয়ে যায়। পরে আমরা কুমিল্লায় গিয়ে রাতিনকে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ২৯ মার্চ রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে সে মারা যায়। সেখানেই রাতিনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ময়নাতদন্তের কোনো কাগজপত্র দেওয়া হয়নি।'
নিহতদের আসামি করার ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার বাদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সোহরাব হোসেন বলেন, 'মামলায় ঘটানাটি আমি ২৭ মার্চ দেখিয়েছি। তখন তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। পরে হয়তো তারা মারা গেছেন'।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'মামলার তদন্তের জন্য সুহিলপুরে গিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনি এক আসামি রাতিন সংঘর্ষে মারা গেছে। এজহারে আসামিদের নাম দিয়েছেন বাদী। কেউ মারা গিয়ে থাকলে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে।'
উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা। তারা সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তিনদিনের তাণ্ডবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত হন।
তাণ্ডবের ঘটনায় ৫৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মালায় এজহারনামীয় আসামি ৪১৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা আসামি ৩৫ হাজারেরও বেশি। আজ সোমবার (২৬ এপ্রিল) পর্যন্ত ৩৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।