জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় টিকাদানে পিছিয়ে সেক্স ওয়ার্কাররা
২৫ বছর বয়সী সোনিয়া আক্তার (প্রকৃত নাম নয়), দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর একজন সেক্স ওয়ার্কার। দেশে করোনাভাইরাসের টিকার জন্য ন্যূনতম বয়স বয়স ২৫ হলেও জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় করোনাভাইরাসের টিকা নিতে পারছেন না তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে সোনিয়া জানান, করোনা সংক্রমণ এড়াতে তাদের পল্লীতে ক্যাম্প করে ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তিনিও ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্ম নিবন্ধন কার্ড না থাকায় তিনি ভ্যাকসিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না ।
সোনিয়া আক্তারের মতো জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকায় করোনাভাইরাসের টিকা নিতে পারছে না অধিকাংশ সেক্স ওয়ার্কার। আগে করোনার টিকা নিতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক হলেও, এখন জন্ম নিবন্ধন কার্ড দেখিয়েও টিকা নেওয়ার সুযোগ আছে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ আগস্ট ক্যাম্প করে দৌলদিয়ার যৌনপল্লীতে সাড়ে ৫০০ জন সেক্স ওয়ার্কারকে ভ্যাকসিন দিয়েছে সরকার। যদিও সেখানে বাসিন্দা রয়েছে প্রায় ১৪০০।
গোয়ালন্দ রাজবাড়ির স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যৌনপল্লীতে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার নেতৃত্বে থাকা ডা আসিফ মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে আগ্রহ না থাকলেও এখন কাউন্সিলিং করায় সেক্স ওয়ার্কারদের করোনার টিকা নিতে আগ্রহ অনেক বেড়েছে। কিন্তু অধিকাংশের বয়স কম থাকায়, আবার অনেকের এনআইডি কার্ড বা জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকায় তারা ভ্যাকসিন নিতে পারছেনা।
যৌনপল্লীতে টিকাদান কর্মসূচিতে নেতৃত্বদানকারী ডা আসিফ বলেন, দৌলদিয়ার সেক্সওয়ার্কারদের এনআইডি কার্ড করে দিতে আমরা নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করেছি। সেক্সওয়ার্কারদের টিকার নিবন্ধন করে দিতে এনজিওগুলো সাহায্য করছে।
দেশে করোনাভাইরাসের পর্যাপ্ত টিকা আসলে আবারও ক্যাম্প করে দৌলদিয়ায় ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ক্যাম্প না হলে যারা রেজিস্ট্রেশন করছে তাদের আমরা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ৪০ বছর ও তার বেশি বয়সী ১৫০ জনকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এরপর ১৮ আগস্ট ক্যাম্প করে ২৫ বছরের বেশি বয়সী চারশো যৌনকর্মীকে করোনার টিকা দেয়া হয়েছে।
দেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে গণটিকা দেয়া শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ১.৫৯ কোটি মানুষ অন্তত এক ডোজ ও ৬১.২৯ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন।
দৌলদিয়ার এক চতুর্থাংশ সেক্সওয়ার্কার ক্যাম্পের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের আওতায় আসলেও ভাসমান বা অন্যান্য যৌনপল্লীর যৌনকর্মীরা টিকার আওতার বাইরে।
ইউএনএআইডিএস এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে সেক্স ওয়ার্কারের সংখ্যা ১৪০,০০০। বাংলাদেশে সেক্স ওয়ার্কাররা হোটেল, বাসা, রাস্তা ও যৌনপল্লীতে ক্লাইন্টের সাথে দেখা করে। দেশে ১০টি যৌনপল্লী রয়েছে।
তবে দৌলদিয়া যৌনপল্লীর বাইরে কত শতাংশ সেক্স ওয়ার্কার ভ্যাকসিন পেয়েছে সে তথ্য কারো কাছে নেই।
সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্কার অব বাংলাদেশের সভাপতি আলেয়া আক্তার লিলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেক্স ওয়ার্কার অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ফলে তারা টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখনো এক শতাংশের বেশি যৌনকর্মীও টিকার আওতায় আসেনি বলে আমাদের ধারণা।
আলেয়া আক্তার বলেন, বলেন, লকডাউন শিথিল করায় এখন যৌনকর্মীরা ক্লায়েন্টদের সংস্পর্শে যাচ্ছেন। এখন যদি তাদের টিকা দেওয়া না যায় তাহলে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। এ কারণে আমাদের দাবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া যৌনকর্মীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনা হোক। প্রয়োজনে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকৃত যৌনকর্মীদের তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ডা আবু জামিল ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেক্স ওয়ার্কাররা অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসে বলে তাদের ও তাদের মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
ডা নাজমুল ইসলাম, মুখপাত্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেক্স ওয়ার্কার, থার্ড জেন্ডার সবাইকে আমরা ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে চাই। ভ্যাকসিন দিতে হলে একটা পরিচয়পত্রের প্রয়োজন রয়েছে কারণ সেকেন্ড ডোজ দেয়ার প্রয়োজন আছে। আমরা সেটি নিশ্চিত করতে কাজ করছি।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের ভ্যাকসিন বিষয়ক গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সাবেক পরিচালক ডা. এএম জাকির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যৌনকর্মীদের টিকা দেওয়ার সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিউষদ থেকে যৌনকর্মীদের অন্তত জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
"আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি, যৌনকর্মী এবং অন্যান্য দুর্বল জনগোষ্ঠীকে এই সময়ে এনআইডি কার্ডের জন্য আবেদন করার সমস্যা থেকে রেহাই দিন। কারণ এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। তাই স্বাস্থ্য বিভাগের টিকাদানের কিছু শর্ত মওকুফ করা উচিত।'
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে