জলবায়ু ফান্ডের টাকায় খালের ওপর স্ল্যাব

চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভা সদরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে খালের ওপর আরসিসি স্ল্যাব। এছাড়াও একই প্রকল্পে লাগানো হয়েছে ২০টি সোলার লাইটও। তিন কোটি টাকার এ প্রকল্প এরই মধ্যে বাস্তবায়নও করা হয়েছে। পাশাপাশি ট্রাস্ট ফান্ড থেকে অর্থায়নের জন্য আরও একটি প্রকল্পের জন্য পাঠানো হচ্ছে প্রস্তাবনাও। এর আগে চট্টগ্রামের বন গবেষণা ইনস্টিটিউট জলবায়ু ফান্ডের টাকায় নির্মাণ করেছে রিটেইনিং ওয়াল ও সংস্কার করেছে রাস্তা।
জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও আরসিসি স্ল্যাবের মাধ্যমে প্রাইমারি ড্রেন নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
সরকার ও বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থা জয়বায়ু পরিবর্তনরোধ ও অভিযোজনের কাজে ব্যয় করার শর্তে পরিবেশ ও বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠিত জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডকে এ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের এ ধরনের কাজে খরচ করার কারণে ভবিষ্যতে বিদেশি দাতারা এ খাতে আর অর্থ বরাদ্দ দিবে না বলে মনে করছেন জয়বায়ু ও পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা।
সরেজিমন গিয়ে দেখা যায়, হাটহাজারী মডেল থানার দক্ষিণ দিকে মরা ছড়া খাল (পাহাড়ি ছড়া)। হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কের এ ছড়ার উপর রয়েছে একটি কালভার্ট। কিন্তু কালভার্টের পশ্চিম পাশে খালের অস্তিত্ব বোঝা গেলেও পূর্বদিকে নেই কোনো খাল। প্রাকৃতিক এ ছড়াকে আবৃত করা হয়েছে আরসিসি স্ল্যাব দিয়ে। কালভার্ট থেকে আরসিসি স্ল্যাব দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাটহাজারী কাচারি সড়কের ব্রিজ পর্যন্ত। স্ল্যাবের দুই পাশে রাখা হয়েছে চলাচলের পথও।
এ প্রসঙ্গে হাটহাজারী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী বেলাল আহমদ খান বলেন, জলবায়ু ফান্ডের টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটি প্রত্যক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সহায়ক না হলেও পরোক্ষভাবে কাজ করছে। এ খালের মধ্যে আরসিসি স্ল্যাব বসানোর কারণে এ উপজেলা সদরে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়েছে। এ খালের ৩৫০ মিটার আরসিসি স্ল্যাব বসানো হলেও বাকি অংশে আবার আরসিসি স্ল্যাব বসানোর জন্য আরও একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু ট্রাস্টের টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় না হয়ে এ ধরনের কাজ করা হয় তাহলে বিদেশি দাতারা এ খাতে আর অর্থ বরাদ্দ দেবে না। ক্ষতি মোকাবেলা করাও সম্ভব হবে না।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় হাটহাজারী পৌর এলাকায় আরসিসি প্রাইমারি ড্রেন নির্মাণ এবং খুঁটিসহ সৌর বিদ্যুতায়িত সড়ক বাতি স্থাপনের জন্য এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
২০১৫ সালে নেওয়া এ প্রকল্পের আওতায় ৩৫০ মিটার স্ল্যাবসহ আরসিসি প্রাইমারি ড্রেন নির্মাণ করা হয়। ২০১৮ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া এ প্রকল্পের কাজ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী। এ জন্য ব্যয় হয় দুই কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়াও এ প্রকল্পের আওতায় ২০টি সোলার বাতি খুঁটিসহ স্থাপনের জন্য ব্যয় করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন, সংশোধন, বাস্তবায়ন, অর্থ অবমুক্তি এবং ব্যবহার নীতিমালা বলা হয়েছে- জলবাযু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি, কার্যক্রম থাকতে হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে যে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাবে প্রকল্প প্রস্তাবে তা উল্লেখ করতে হবে। কিন্ত চট্টগ্রামে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার কোনো যৌক্তিকতা খোঁজে পাচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
হাটহাজারী পৌর সদর এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খালকে এভাবে আরসিসি স্ল্যাব দিয়ে ড্রেন বানাতে দেখিনি। এখন বর্ষাকালে ড্রেন পানির চাপ নিতে না পেরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় কাচারি সড়কে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমিন দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাধারণত জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় মিটিগেশন এবং এডাপটেশন করা হয়। খালের মধ্যে আরসিসি স্ল্যাব নিয়ে কীভাবে জলবায়ু প্রতিরোধ হবে জানি না। অপাত্রে ঘি ডালার মতো এ প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্প বাড়তে থাকলেও বিদেশি কোনো সাহায্য আসবে না।
একই প্রসঙ্গে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আবদুর রহমান রানা বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ট্রাস্ট ফান্ড থেকে বিভিন্ন পৌরসভায় ফান্ড দেওয়া হচ্ছে। আর এ ফান্ডের টাকা দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। যে যেভাবে পারে এ টাকা আনতে পারে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খালের উপর স্ল্যাবে যদি জলাবদ্ধতা বাড়ে তবে সে ফান্ড মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তাছাড়া ট্রাস্টের মনিটরিংয়ের অভাবে স্থানীয় প্রকৌশলীরা তাদের ইচ্ছামতো কাজ করে থাকে।
এর আগে চট্টগ্রামে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে চার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় সড়ক, মাঠ সংস্কার, রিটেইনিং ওয়াল এবং সৌন্দর্য্যবর্ধনের কাজ করা হয়।
এ বিষয়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের সহকারী পরিচালক জানে আলম বলেন, ট্রাস্ট ফান্ডের অনেকগুলো প্রকল্প বিভিন্ন পৌরসভায় দেওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য মূলত এ ধরনের প্রকল্প দেওয়া হয়। ট্রাস্ট থেকেও বিষয়টি মনিটরিং করা হয়। কোথাও কোনো ধরনের গাফলতি থাকলে তা নজর দারিতে আনা হয়। হাটহাজারীর প্রকল্পটি জনদুর্ভোগ লাঘব না করলে পুনরায় প্রকল্প দেওয়ার জন্য ট্রাস্টি বোর্ডকে জানানো হবে।