জনবল সংকটে ধুকছে শালবন বিহার
উপমহাদেশের প্রাচীন শহর কুমিল্লার দর্শনীয় ও প্রত্নতত্ত্ব স্থানগুলোর মধ্যে কোটবাড়ির ময়নামতি জাদুঘর ও শালবন বিহার অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে পর্যটনের এই সাইটটিতে পর্যটক ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেলেও একযুগ ধরে চলতে থাকা জনবল সংকটের সমাধান হয়নি আজও। প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লোকবল নিয়েই চলছে প্রসিদ্ধ এ প্রত্নতত্ত্ব স্থানটি। ফলে নিরাপত্তার ঘাটতিও রয়েছে ব্যাপক। প্রায়ই ঘটে ছিনতাইসহ নানা ঘটনা।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ির ময়নামতিতে শালবন বিহার অবস্থিত। প্রায় ৩৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত শালবন বিহারটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার। সমতল থেকে যার উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। বুদ্ধ রাজাদের সময় সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে এ বিহার স্থাপিত হয়। আর ময়নামতি জাদুঘরে রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান দু’টি।
ঐতিহাসিক এই শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম হয়। বিশেষ করে ছুটির দিন ও শীতকালে পর্যটক আর বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পিকনিক পার্টি ও শিক্ষা সফর এবং পারিবারিক ভ্রমণে মুখরিত হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক এ সাইটটি।
এদিকে, শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে গত ১২ বছর ধরে অনেকগুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। যা সার্বিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
জানা যায়, কুমিল্লার শালবন বিহার ও জাদুঘরের ২৬টি পদের মধ্যে পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া প্রেষণে রয়েছেন পাঁচজন। নিরাপত্তাকর্মীর চার জনের মধ্যে একটি পদ শূন্য। লোকবলের সংকট থাকা সত্ত্বেও শালবন বিহার ও জাদুঘর থেকে আরও এক কর্মকর্তাকে ইটাখোলা মুড়া ও রূপবানমুড়াতে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ে শূন্য পদ রয়েছে সাতটি।
ফলে এত কম সংখ্যক জনবল দিয়ে বিশাল শালবন বিহারের নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন বিহারের ফটকে দুইজন লোক পালাক্রমে টিকিট দেখার দায়িত্বে থাকেন। আর ভেতরে পর্যটকদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন আরও দুইজন। দর্শনার্থীদের ভেতর কিশোর-কিশোরীর সংখ্যাই বেশি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বিগত বছরগুলোতে বিহারের চারপাশের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে বহিরাগত বখাটেরা বিহারে প্রবেশ করে পর্যটকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করতো, মোবাইল-ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিতো। গত দেড় বছরে তা হ্রাস পেলেও বিহারের প্রাচীরের বাইরে তা অহরহ ঘটছে।
গত ১৪ জানুয়ারি শালবন বিহার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় সাহিদ (২৮) নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয় দুবৃর্ত্তরা। বিগত বছরের ১৮ ডিসেম্বর শালবন বিহারের প্রাচীরের বাইরে বৌদ্ধ বিহারের সামনে কুমিল্লা মহিলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় স্থানীয় বখাটেরা।
এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই প্রত্নতত্ত্বস্থানে বর্তমানে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। গত ছয় মাস ধরে সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে আছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শালবন বিহার ও জাদুঘরে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ১৪টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। কয়েক মাস পরেই সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। পরে ছয়টি ক্যামেরা ঠিক করা হয়। সেগুলোও বিগত ছয় মাস ধরে নষ্ট হয়ে আছে।
শালবন বিহারে ঘুরতে আসা কুমিল্লা সদরের পাচঁথুবী এলাকার বাসিন্দা শাহ ইমরান ও রাজধানী থেকে আসা বাবু সালাম জানান, শালবন বিহার প্রত্নতাত্ত্বিক ও সৌন্দর্য্য উভয় বিচারে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আমরা বছরে পাঁচ/ছয়বার এখানে ঘুরতে আসি। কিন্তু এখানে নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
তারা জানান, বিহারের ভেতরে আপাতত কোনো সমস্যা না হলেও বিহারের চারপাশের প্রাচীরের বাইরে স্থানীয় বখাটেদের আনাগোনা থাকে। অন্তত বিহারের প্রধান ফটক ও চারপাশের প্রাচীরে কয়েকটি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করলে ও কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী টহল দিলে পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারবে। সেই সঙ্গে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে।
কুমিল্লা ময়নামতির শালবন বিহার ও জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘শালবন বৌদ্ধবিহার ও জাদুঘরের সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে আছে। এগুলো মেরামতের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া কম লোকবল নিয়েও পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে আমরা তৎপর রয়েছি।’’
জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ শালবন বিহার ও জাদুঘরে প্রায় ৪৯ লাখ দেশি পর্যটক ও ১১ হাজার ১২১ জন বিদেশি পর্যটক এসেছেন।
ফলে টিকিট, বুকলেট বিক্রি, গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট, বিশ্রামাগার বাবদ প্রতিদিন প্রচুর অর্থ আয় হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আয়ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে দেশি পর্যটকের জন্য ২০ টাকা, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচ টাকা, সার্কভূক্ত দেশের বিদেশি পর্যটকের জন্য ১০০ টাকা ও অন্যান্য বিদেশি পর্যটকের জন্য ২০০ টাকা প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা রয়েছে।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরে রাজস্ব আয় ছিল এক কোটি ২২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ টাকা, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯১ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার ৮১৫ টাকা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান জানান, ১৯৮৭ সালে যে পদ সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো বহাল রয়েছে। নতুন করে আর পদ সৃষ্টি হয়নি। শালবনবিহার ও জাদুঘরের মত একটি সাইট পরিচালনার জন্য অন্তত ৬০ জন লোকের প্রয়োজন। সেখানে আমাদের আছে মাত্র ২৬ জন। তার মধ্যে আবার পাঁচটি পদ শূন্য ও পাঁচজন প্রেষণে রয়েছেন। আমরা শুন্যপদে লোকবল নিয়োগের জন্য বেশ কয়েকবার সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করেছি।
নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আগের তুলনায় নিরাপত্তা অনেক বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবল পেলে এটি হবে বিশ্বমানের পর্যটন স্থান।