চট্টগ্রাম সিটিতে এখনো সরকারি ত্রাণ পায়নি ৬৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার
চট্টগ্রাম নগরীর বালুচড়া এলাকার অবস্থিত মোজফফর কলোনী। এ কলোনীতে খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের শতাধিক পরিবার বসবাস করে। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে আয় বন্ধ হলেও এখনো পর্যন্ত পাননি সরকারি কোন সহায়তা। ফলে দুর্দশায় জীবন যাচ্ছে নিম্ন আয়ের এসব মানুষদের।
শুধু মোজাফফর কলোনী নয়; চট্টগ্রাম নগরীর বার্মা কলোনী, আইস ফ্যাক্টরী সড়কের রেলওয়ে কলোনীসহ অনেক বস্তিবাসীর কপালে জুটেনি সরকারি কোন সহায়তা। ফলে কোথাও ত্রাণের হাহাকার হচ্ছে, আবার কেউ ত্রাণ নিতে গেলে লাঞ্চনারও শিকার হচ্ছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অন্তত ৫০টি সংস্থা নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেলায় এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৩৮ মেট্রিক টন ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ লাখ বস্তিবাসীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯৯০ মেট্রিক টন। সামান্য এ ত্রাণ দিয়ে শহরের নিম্ন আয়ের সব মানুষদের কাছে বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও হচ্ছে নগরে।
মোজাফফর কলোনীর আহমেদ বলেন, দিন মজুরীর কাজ করে সংসার চালতাম আমি। লকডাউনের পর থেকে তাও বন্ধ। সরকার ত্রাণ দেওয়ার কথা বললেও তা পাইনি আমরা। এলাকার কারো কাছ থেকেও কোন ধরণের সাহায্য সহায়তাও পাইনি আমরা। ফলে দুঃখে কষ্টে দিন যাচ্ছে আমাদের।
একই প্রসঙ্গে নগরীর বার্মা কলোনীর শৈল রানী বলেন, আমরা এখনো কোন ত্রাণ পাইনি। শুনেছি অনেকে ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু আমার কপালে তাও জুটেনি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের করা তালিকা অনুযায়ী নগরে নিম্ন আয়ের পরিবার আছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার। এর মধ্যে করপোরেশন থেকে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার পরিবারের মধ্যে। যা শতাংশ হিসেবে মাত্র ৩৩ শতাংশ। ফলে প্রায় ৬৭ শতাংশ নগরবাসী এখনো পাননি সরকারি ত্রাণের দেখা।
৬০ লাখ নগরবাসীর এ শহরে প্রায় ৬ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারের এ তালিকা মনগড়া বলছে কনজিউম্যার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)। সংস্থাটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে নিম্ন আয়ের ও ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য ৩০ লাখ মানুষ আছে। কিন্তু আমাদের যদি সঠিক ডাটাবেইস থাকতো তাহলে ত্রাণ বিতরণে কোন ধরণের সমস্যা তৈরি হতো না। যারা দিচ্ছে তা খুবই নগন্য। বেসরকারিভাবে যারা দিচ্ছে তারাও যদি সমন্বয় করে দিতো তাহলে দুইবার ত্রান কেউ পেতো না।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মো. সামসুদ্দোহা বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১ লাখ ৯৮ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। কাউন্সিলরদের করা তালিকা অনুযায়ী এ ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও মেয়র মহোদয়ের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় শনিবার পর্যন্ত ৩ তিন হাজার ১০৯ মেট্রিক টন চাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিতরণ করছে। এর পাশাপাশি নগদ টাকা হিসেবে বরাদ্দ পেয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও শিশু খাদ্য হিসেবে ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে ১৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী বলেন, প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে ত্রাণ হিসেবে চাল দেওয়া হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিটি পর্যায়ে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে এসব ত্রাণ। শিশুখাদ্য হিসেবে দুধ, সুজি, চিনিও বিতরণ করা হচ্ছে। জেলা পর্যায় থেকে আড়াই হাজার গুড়– দুধ বিভিন্ন উপজেলা ও সিটি করপোরেশনে বিতরণ করা হয়েছে। যারা ত্রাণ নিয়ে নয়ছয় করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন।
কী দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ হিসেবে
সরকারি ত্রাণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী উপহার সম্বলিত ব্যাগে প্রতি পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে ১০ কেজি চাল। এছাড়াও শিশু খাদ্য হিসেবে দেওয়া হচ্ছে গুড়া দুধ,সুজি এবং চিনি। বেসরকারি পর্যায়ে চাল, ডাল, তেল, আলু ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিনামূল্যে সবজিও বিতরণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে ত্রাণ নিতে আসা বৃদ্ধাকে লাথি মারার অভিযোগ
চট্টগ্রামে ত্রাণ নিতে আসা নূরজাহান (৬০) নামের এক বৃদ্ধাকে লাথি মারার অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৬ নং উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাশেমের অনুসারী মো. নাসির এ লাথি মেরেছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এ বিষয়ে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ত্রাণ নিয়ে আসা বৃদ্ধাকে লাথি মারার বিয়ষটি অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলরও।
ত্রাণের জন্য আসা বৃদ্ধাকে থাপ্পড় মারলেন মহিলা ইউপি মেম্বারের স্বামী
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ত্রাণ চাইতে গিয়ে বৈরাগ ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার কুনছুমা আকতারের স্বামী আবদুল আজিজের থাপ্পড় খেলেন কুনছুমা বেগম নামের এক বৃদ্ধা।
গত ২৫ এপ্রিল উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের আমান উল্লাহপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মহিলা ইউপি সদস্য ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে আনোয়ারা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই বৃদ্ধা।
বৃদ্ধা কুনছুমা বেগম জানান, করোনা ভাইরাসে চরম অর্থসংকটের মধ্যে জীবনযাপন করছেন কুনছুমা। এ পর্যন্ত কোনো সাহায্য সহযোগিতা না পেয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে ত্রাণের জন্য যান স্থানীয় মহিলা মেম্বারের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখেন আরও অনেক লোক ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনিও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ত্রাণ না পেয়ে তালিকায় নাম নেই কেন জানতে চান ইউপি মেম্বারের কাছে। এ সময় চরম রেগে গিয়ে মহিলা মেম্বারের স্বামী বৃদ্ধাকে চড়-থাপ্পড় মেরে বের করে দেন।
সরকারি ত্রাণে ভাগ চাইলেন সাংসদ
করোনাভাইরাস উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকারি ছুটি ছাড়াও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া দুটি উপজেলাই লকডাউনে। দীর্ঘ ছুটিতে নিম্ন আয়ের মানুষ এমনিতেই কর্মহীন, তার ওপর লকডাউনে আরো শোচনীয় অবস্থা। এই অবস্থায় ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। আর সেই সহযোগিতায় ভাগ বসাতে চাইছেন স্থানীয় সাংসদ আবু রেজা নদভী।
এমপির নামে ২৫ শতাংশ ত্রাণ চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন তিনি।
২৯ এপ্রিল সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি নিজের নামে ২৫ ভাগ, উপজেলা চেয়ারম্যানদের নামে ১৫ ভাগ আর বাকি ৪০ ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অনুকূলে বরাদ্দ চেয়েছেন।
ছবি তুলে ত্রাণ কেড়ে নিলেন চেয়ারম্যান
ত্রাণ দেওয়ার ছবি তোলার পর ২৬টি পরিবারের কাছ থেকে তা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে চেয়ারম্যান ও তার লোকজনের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন অসহায় পরিবারগুলো।
৭ এপ্রিল দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদে এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হয় ওই চেয়ারম্যানকে।
সরকারি চাল ব্যবসায়ীর গুদামে
চট্টগ্রামে একটি গুদাম থেকে ৬৩০ কেজি সরকারি চাল ও দেড় হাজার সরকারি চালের খালি বস্তা উদ্ধার করে পুলিশ।
৭ এপ্রিল নগরের ডবলমুরিং থানার ঈদগাহ কাঁচা রাস্তার মোড় মুনমুন কমিউনিটি সেন্টার গলির ভেতরে বিসিক গোডাউন থেকে চালগুলো উদ্ধার করা হয়। চালগুলো পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী ফারুক ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ ওমর ফারুকের কাছে পাওয়া যায়। ঘটনাস্থল থেকে ফারুক ট্রেডার্সের কর্মচারী আরাফাত মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়।