খোঁড়াখুঁড়ি আর উন্নয়ন কাজে ঢাকার নাভিশ্বাস দশা
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ ওয়ার্ডেই চলছে বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়াও চলমান আছে মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ। এ কারণে ভেঙে পড়েছে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা। দেশে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের পর থেকেই রাজধানীতে বাড়ছে যানজট। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে অফিসগামী লোকজন।
দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হওয়ায় আগামী সপ্তাহ থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। কিন্তু রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার এমন অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে বলেও আশঙ্কা নগরবাসীর।
প্রতিদিন যারা যাতায়াত করেন, বিশেষ করে যারা সপ্তাহে ছয়দিন অফিসে যান, তাদেরকে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাজধানীর অন্তত ৪০টি স্থানে রাস্তা কেটে চলছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। ফলে দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে।
নিয়মিত যাত্রীরা বলছেন, চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, শহরের রাস্তায় পথচারী ও যানবাহন বৃদ্ধি এবং বেপরোয়া যান চালনার কারণে এই খেসারত দিতে হচ্ছে তাদের।
রাজধানীর ট্রাফিক বিভাগ বলছে, চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পসহ মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে যানজটের এ ভোগান্তি থেকে নগরবাসী মুক্তি পাবেন। এছাড়া বিভিন্ন রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে গেছে বলছেন তারা।
রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা সলিম খান টিবিএসকে বলেন, আমার অফিস গুলশান-১-এ হওয়ায় এখান থেকে স্বাভাবিকভাবে যেতে ২৫ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ২ ঘণ্টার আগে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়েই বারবার থামতে হয়েছে। এ দুর্বিষহ যানজট থেকে মুক্তি পেতে সড়কগুলো নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত।
তিনি আরও বলেন, সামনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে রাস্তায় হেঁটে চলাই তো কঠিন হয়ে যাবে। বাচ্চাদের স্কুল কলেজে পাঠিয়ে বাসায় ফেরা পর্যন্ত অভিভাবকদের চিন্তায় থাকতে হবে।
মালিবাগের বাসিন্দা হেমায়েত উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, মালিবাগের এ রোডে বেশ কয়েকদিন ধরেই কাজ চলছে। একবারে পুরো রাস্তা খুঁড়ে রেখে দেয়। এত বড় রাস্তার একপাশ দিয়ে কোনোভাবে বাস চলাচল করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে জ্যামে পড়ে থাকতে হয়। একদিকে গরম আবার জ্যাম, সব মিলিয়ে চরম অস্বস্তিতে চলাচল করতে হয়।
রোববারের বিভিন্ন রাস্তার যানজটের খবর নিয়ে জানা যায়, নগরীর বেশিভাগ রাস্তাই ছিল যানজটে ঠাসা। গাজীপুর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে গুলিস্তানে আসতে অনেকেরই লেগেছে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। এছাড়া তেজগাঁও, মহাখালীর রাস্তার অধিকাংশ স্থানেই রাস্তা কাটা থাকায় অনেকের বসে থাকতে হয়েছে কয়েক ঘণ্টার যানজটে।
রাজধানীর বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, টিকাটুলি মোড়, গুলিস্তান, জিপিও মোড়, পল্টন মোড়, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, নিউ মার্কেট, মগবাজার, মৌচাকসহ বেশ কয়েকটি স্থানের প্রধান সড়কগুলোতে সকাল থেকেই বাড়তে থাকে যানজট। যার তীব্রতা দেখা যায় দুপুরে এবং এ যানজট দিন পেরিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত থেমে থেমে দেখা যায়।
রাস্তা সরু হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াও রাজধানীর সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহনের চালক ও পথচারী কেউই আইন মানছেন না বলেও অভিযোগ ট্রাফিক বিভাগের।
রাস্তায় চলাচলকারী অনেকেরই অভিযোগ, সুযোগ পেলেই ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করছে গাড়ির ড্রাইভাররা। ভুল বা 'রং সাইড' দিয়ে যানবাহন চালানো, ট্র্যাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, ফুটপাত দিয়ে যানবাহন চালানো ঢাকার চিরচেনা দৃশ্য।
ফার্মগেটে ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়া পথচারী সায়মা হক টিবিএসকে বলেন, রাস্তায় সবাই আগে যেতে চায়, তা সে যেভাবেই হোক না কেন। এর ফলাফল হলো, কেউই আর শেষ পর্যন্ত আগে যেতে পারে না৷।তার ওপর ফুটওভার ব্রিজ বা ফুট ব্রিজ ব্যবহার না করে পথচারীরা মূল সড়কের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পারাপার করে সড়কের গতি কমিয়ে দেন। এসব ছোট ছোট অব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়।
ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, রাজধানীতে ৪ হাজার ট্রাফিক সদস্য তিন পালায় দিনরাত কাজ করেন প্রায় ৬০০ ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে।
খানাখন্দের প্রভাব যে শুধু কাটা রাস্তাগুলোতেই পড়েছে, এমনটা নয়। এর প্রভাব পড়ছে প্রতিটি রাস্তায়ই। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার চলমান কাজের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রায় ৩০টি এবং উত্তর সিটির ১০টি এলাকায় রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে।
স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি)-এর তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় প্রায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের প্রায় ৭০ ভাগ। ঢাকায় প্রায় ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন এবং এরা ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা দখল করে থাকেন। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী গণপরিবহন ব্যবহার করেন, যারা মাত্র ৩০ ভাগ রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ পান।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ মুহূর্তে ওয়াসার ২টি প্রকল্প চলমান আছে। একটি বাসা বাড়ির পানির লাইন এবং আর একটি ঢাকায় পানি সরবরাহের লাইনের কাজ চলমান আছে। এতে মূল রাস্তায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। গলির মধ্যে কিছু কিছু স্থানে কাজ চলছে।
এ বিষয়ে ওয়াসার এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, বর্তমানে ওয়াসার কোনো উন্নয়নমূলক কাজের কারণে রাস্তায় যানজট হচ্ছে না। যেসব রাস্তায় কাজ চলছে সেগুলো অধিকাংশই সিটি কর্পোরেশনের।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ঢাকায় চলমান উন্নয়নমূলক কাজগুলো সম্পূর্ণ হলে যানজট কমবে বলে আশা করছি। এছাড়া ঢাকার অধিকাংশ স্থানেই বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলমান রয়েছে, এজন্য মূলত যানজট বেশি দেখা দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রাস্তায় মানুষ, যানবাহন প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিন্তু বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান থাকায় রাস্তার জায়গা আরও কমছে। আবার পুরান ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে এবং মার্কেটের আশপাশে মানুষ রাস্তা দিয়েই হাঁটছে, অথচ সেখানে রিক্সা চলার মতো অবস্থাও থাকে না। তবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। গাড়ি বেড়ে গেলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না; উল্টো আমাদের উপর চাপ আরও বেড়ে যায়।
সামনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে তখন মানুষ ও যানবাহনের চাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে ট্রাফিক, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের একইভাবেই তো কাজ করতে হবে। নতুন কোনো নির্দেশনা আসলে সেভাবে আগাব। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে যানজট আরও বেড়ে যাবে।