খবর পৌঁছে দিতে চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত প্রায় ১০০ সংবাদকর্মী, হারিয়েছেন স্বজনও
দেবব্রত রায়, দৈনিক বণিকবার্তা চট্টগ্রাম অফিসে স্টাফ রির্পোটার হিসেবে কর্মরত। প্রতিদিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি বের হতেন। বাসায় তার মা ছিলেন। হঠাৎ তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬ এপ্রিল মারা যান। ১২ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর, এক ছোটবোন ও মাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। মা-ই ছিল তার সব।
তিনি বলেন, "আমি যেহেতু বাসা থেকে বের হতাম এবং আমার করোনার লক্ষণ ছিল, আমার ধারণা আমার থেকে মা আক্রান্ত হয়েছেন।"
একইভাবে যুগান্তরের সিনিয়র রির্পোটার মিজানুল ইসলামের ৭৫ বছর বয়সী বাবা (নুরুল ইসলাম) মারা যান ২ এপ্রিল। গত ১৭ মার্চ থেকে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন মিজানুল।
তিনি বলেন "বাবা বাসা থেকে বের হতেন না। আমি আক্রান্ত হবার পর বাবা আমার জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছেন। অথচ বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। বাবা হয়ত আমার কাছ থেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।"
মিজানুলের ১ বছর বয়সী মেয়েও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। করোনায় মাকে হারিয়েছিলেন আরেক সাংবাদিক এনটিভির ক্যামেরা পার্সন এনাম হায়দার।
সংবাদ সংগ্রহে প্রতিদিন ছুটে চলছেন সংবাদকর্মীরা। নিজে ঝুঁকি নিচ্ছেন । পরিবারের জন্য ও ঝুঁকি হচ্ছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় শতাধিক সংবাদকর্মী।
চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বৃদ্ধির পর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আরও বেশি ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকরা। গত ১৫ দিনে চট্টগ্রামের অন্তত দশজন সংবাদকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে স্থানীয় দৈনিক আজাদীর চীফ রির্পোটার হাসান আকবরের অবস্থা গুরুতর। যিনি দুই সপ্তাহ আগে মাকেও হারিয়েছিলেন।
"যদিও আমরা প্রতিদিন মানুষের জন্য কয়েক হাজার শব্দ লিখি, কিন্তু করোনা মহামারীর এই কঠিন মুহুর্তে দেশের সংবাদকর্মীদের জন্য দুঃখ প্রকাশে আমাদের কাছে ভাষা নেই, নিজেদের এবং পরিবারে ঝুঁকি নিয়ে অবিরাম সংবাদ পৌঁছে দিতে তারা ছুটে চলছেন," বলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ।
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যুরো প্রধান কামাল পারভেজ- বলেন, 'করোনায় কাজ করা সম্প্রচার মাধ্যমের সংবাদকর্মীদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জের। কারণ, ছাপা বা অনলাইনমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা অনেকক্ষেত্রে ভার্চুয়ালি কাজ করার সুযোগ পেলেও সম্প্রচার মাধ্যমে সেটা বেশিরভাগক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তাদের মাঠে সরাসরি কাজই বেশি। ফলে সম্প্রচারমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা আক্রান্তও হচ্ছে বেশি।'
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ইফতেখার ফয়সাল জানান, করোনা সংক্রমণের শুরুর তিন মাসে তাদের হিসেবে ৩৫ থেকে ৪০ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছিলেন; তাঁর ধারণা বর্তমানে এই সংখ্যা একশজন ছাড়িয়ে গেছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার আক্রান্তদের মধ্যে দৈনিক প্রথম আলোয় ৭ জন, যুগান্তর ৪ জন, সমকাল ২ জন, কালের কণ্ঠ ১ জন, বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ জন, আজকের পত্রিকা ১ জন, আমাদের সময় ২ জন, ডেইলি সান ১ জন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ১ জন। এছাড়া স্থানীয় দৈনিক আজাদীর ৫ জন, পূর্বকোণ ১ জন ও পূর্বাদেশ পত্রিকার ৩ সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
ইলেট্রনিক মিডিয়ায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর ৭ জন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ৪ জন, যমুনা টিভি ২ জন, চ্যানেল আই ১ জন, একুশে টিভি ২ জন, একাত্তর টিভি ২ জন, সময় টিভি ৩ জন, মাছরাঙ্গা ২ জন, জিটিভি ২ জন, নিউজ টোয়েন্টি ফোর ১ জন।
এছাড়া অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে বাংলানিউজে ১ জন, ইউএনবি ১ জন, চট্টগ্রাম প্রতিদিন ৩ জন, সি-ভয়েস ২ জন, মহানগর ২ জন, জয়নিউজ এর ১ জন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এর বাইরে আরও অন্তত ৫০ জন সংবাদকর্মী আছেন যারা করোনার বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে-যন্ত্রণায় ভুগে নিজ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী- বলেন, 'আমাদের চার রিপোর্টার, দুই ফটোসাংবাদিক এবং ডেক্সে একজনসহ সাতজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। রিপোর্টাররা যেখানেই যাচ্ছেন, শেষ চেষ্টাটা করেও কোনো মতে রক্ষা হচ্ছেনা।'
সংকট মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে কামাল পারভেজ বলেন 'সংবাদকর্মীদের আক্রান্ত হবার হার কমাতে তৎপর হওয়া বা কাজের ক্ষেত্রে বিকল্প কিছু উপায় বের করা জরুরি। ডিজিটালি সাপোর্ট বাড়িয়ে, বাইরে যাওয়া কমানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।'
করোনায় চ্যালেঞ্জ নিলেও ঝুঁকি ভাতা নেই
করোনা মহামারীতে নানামুখী চাপ এবং প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন দেশের সাংবাদিকেরা। কিন্তু মহামারী মোকাবেলায় চিকিৎসকসহ সম্মুখ সারির যোদ্ধারা ঝুঁকি ভাতা পেলেও দেশেরা সাংবাদিকরা সে সুবিধা বাইরে রয়েছেন। এছাড়া ছাঁটাই, চাকরি আছে বেতন নেই, বেতন কমিয়ে দেয়াসহ নানা সমস্যার মুখে পড়েছেন তারা।
সিইউজের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম বলেন, 'পত্রিকা হাউস গুলোতে করোনাকালীন স্বাস্থ্য সুরাক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এ কারণে মাঠে কাজ করেননা এমন সংবাদকর্মীরাও আক্রান্ত হয়েছেন। এই কড়া লকডাউনে অন্যরা যখন জীবন বাঁচাতে ঘরে অবস্থান করছে, তখন সাংবাদিকরা ঝুঁকি পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু ঝুঁকি ভাতা বলেন বা তাদের সুরক্ষার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত।'
টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লতিফা আনসারি রুনা বলেন, 'সাংবাদিকদের যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের শুধু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ছুঁটিটাই দেওয়া হচ্ছে, এর বাইরে কোনো সুযোগ সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। সাংবাদিকদের কে ঝুঁকি ভাতা দেওয়া উচিত।'