কোভিড-১৯: শনাক্তের হার কমলেও ঝুঁকিমুক্ত নয় বাংলাদেশ
দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে পজিটিভ শনাক্তের হার ১০% নেমে এসেছে। তবে পজিটিভ শনাক্তের হার কমলেও মৃত্যু সেভাবে কমেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শনাক্তের হার কমার তিন সপ্তাহ পর থেকে মৃত্যু কমতে থাকে। সে হিসেবে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা কমবে। তবে ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকানো না গেলে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা প্রকাশ করলে এবং ঈদে চলাচল বাড়লে সংক্রমণ আরো বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে আরও ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক বছরেরও বেশি সময়জুড়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ইতোমধ্যেই ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত দেশে ১১ হাজার ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে কোভিডজনিত কারণে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ হাজার ৪৬টি কোভিড পরীক্ষার বিপরীতে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে শতকরা ১০ দশমিক ৩৪ জনের মধ্যে।
মারাত্মক সংক্রামক এই ভাইরাসটি গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছে দেশের আরও ২ হাজার ১৭৭ জনের দেহে। মহামারি শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে এই শনাক্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৩২ জনে।
করোনাভাইরাস শনাক্তের দিক থেকে এপ্রিল বাংলাদেশের নিষ্ঠুরতম মাস। এপ্রিল মাসের ৩০ দিনে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২,৪০৪ জন, যা এখন পর্যন্ত এক মাসে করোনাভাইরাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
চলতি বছরের এপ্রিলে করোনায় গড়ে প্রতিদিন ৮১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ গত বছর বাংলাদেশে এই মারাত্মক মাসটিতে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১ জন।
গত বছরের জুলাইয়ে সংক্রমণের পিক টাইমে, সংক্রমণ হার ২৫% থেকে ২১% এ নেমেছিল। সেসময় পজিটিভ শনাক্তের হার বেশি থাকলেও মৃত্যু কম ছিল। এছাড়া শনাক্তের হার কমার সাথে সাথে মৃত্যুও কমে। শনাক্তের হার যখন ২৫.২৩% ছিল তখন মৃত্যু্র হার ৫১ ছিল আর সংক্রমণের হার কমে ২১.৯৮% এ নামায় মৃত্যু কমে ২৮ জনে নেমেছিল।
তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভে মৃত্যু অনেক বেড়েছে। এবার পজিটিভ শনাক্ত দ্রুত কমলেও মৃত্যু ততোটা কমেনি। এ বছরের এপ্রিল মাসে পজেটিভিটি রেট বা পজিটিভ শনাক্তের হার যখন ২৩.৫৭% ছিল তখন মৃত্যুর হার ছিল ৯৬। পজেটিভিটি রেট বর্তমানে ১০% এ নেমে আসলেও মৃত্যু ৮০-৯০ জনে ওঠানামা করছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু কিছুটা কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান লকডাউনের কারণে সংক্রমণ কমেছে। সংক্রমণ হার ১০% এ নেমে এলেও এখনো উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয়ার তিন সপ্তাহ পর জটিল রোগীরা মারা যায়। তাই মৃত্যু হার বুঝতে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতির নিম্নগামীতা গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে তাই আমরা আশা করছি মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যু কমবে। যদি সংক্রমণ কমার চিত্র সঠিক হয়ে থাকে তার পরীক্ষাও হয়ে যাবে সে সময়। আগামী দুই সপ্তাহ পর যদি মৃত্যু না কমে তাহলে আমরা বুঝতে পারব সংক্রমণের যে চিত্র আমরা দেখেছি তা প্রকৃত চিত্র না। এর বাইরে গুরুতর সংক্রমণযুক্ত রোগী রয়ে গেছে, তারা হয়তো পরীক্ষার আওতায় আসছেন না'।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, 'আমরা হাসপাতালের চিত্রের সাথে সংক্রমণের চিত্রের মিল পাচ্ছি। হাসপাতালে এখন রোগীর উপচে পড়া ভিড় নেই। মৃতের সংখ্যা এখন উঠানামা করছে, আগামী সপ্তাহ থেকে কমতে শুরু করবে'।
তবে করোনাভাইরাসে পজিটিভ শনাক্তের হার কমলেও আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই। যে কোন সময় আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, 'ম্যান টু ম্যান ট্রান্সমিশন কমাতে হবে। সরকার ঈদের জামাত মসজিদে পড়তে বলেছে, এটি একটি অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। এতে করে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ঈদের জামাত খোলা মাঠে সীমিত পরিসরে দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরে পড়তে হবে। তা না করে অল্প মানুষও যদি বদ্ধ জায়গায় নামাজ পড়ে ঝুঁকি থাকে'।
গত বছরের জুলাই মাসে যখন করোনাভাইরাসের ফার্স্ট ওয়েভের পিক টাইম ছিল তখন মারা গেছেন ১২৬৪ জন। সে সময় একদিনে সর্বোচ্চ ৫৫ জন মানুষ মারা গেছে। এ বছরের এপ্রিলে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ১১২ জন। এ মাসে ৫ দিন দৈনিক মৃত্যু ১০০ এর বেশি ছিল।
মৃত্যু কমাতে কঠোর লকডাউনের তাগিদ দিয়ে আসছিল বিশেষজ্ঞরা। সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে 'কঠোর লকডাউন' জারিও করে। কিন্তু এ কঠোর লকডাউনে গণপরিবহন ছাড়া সবকিছুই চলছে আগের মতো। শপিংমল, সড়ক ও অলিগলিতে মানুষের ভিড় দিনদিন বেড়েই চলছে। এভাবে চলতে থাকলে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবার বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'লকডাউন ও মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা বাড়ায় সংক্রমণ কমেছে। তবে শনাক্তের হার ৫% এর নিচে না নামা পর্যন্ত ঝুঁকি থেকেই যায়। সংক্রমণ কমায় মানুষ যেন মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অবহেলা না করে। পাশাপাশি পরীক্ষার সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহে দৈনিক ৩০ হাজারের বেশি পরীক্ষা করা হলেও এখন তা ২১ হাজারে নেমে এসেছে'।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'এবারের ঈদে গত বছরের মত সারাদেশে মানুষের যাতায়াত যেন না বাড়ে সেদিকে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর ভারতের ভ্যারিয়েন্ট দেশে প্রবেশের ঝুঁকি বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বিগ্ন করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। কমিটি সর্বশেষ সভায় ভারতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বলে যে করোনাভাইরাসের একটি 'ডাবল ভ্যারিয়েন্ট ' চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারত থেকে আগত সমস্ত যাত্রীকে অবশ্যই ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে মানুষের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে নজরদারি জোরদার করতে হবে। কমিটি এ বিষয়ে কোনও প্রকার গাফিলতি না দেখানোর অনুরোধ করেছে।