কেন বন্ধ হচ্ছে না হাতি নিধন?
এশিয়ান বুনো হাতি আছে এমন দেশের সংখ্যা মাত্র তেরোটি। বাংলাদেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগ ও শেরপুরে হাতির এই বিরল প্রজাতির আবাসস্থল। কিন্তু সম্প্রতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে মানুষের হাতে হাতির মৃত্যুর ঘটনা। খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতি মারা পড়ছে মানুষের পাতা ফাঁদে অথবা গুলিতে। নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়ে বিলীন হওয়ার পথে পাহাড়ের ঐতিহ্য এশিয়ান হাতি।
সাম্প্রতিক সময়ে হাতি চলাচলের করিডোরে অবাধে চাষাবাদ, বাগান করা, বসতি নির্মাণ, পাহাড়ে হাতির খাদ্য সংকটসহ নানান কারণে প্রায়শই মানুষের মুখোমুখি হয়ে পড়ছে হাতি; প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ এবং হাতি উভয়ই। যদিও বন আর হাতি রক্ষার দায়িত্ব যে বন বিভাগের, তারা নিহত হাতির ও মানুষের মরদেহ উদ্ধার বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারছে না।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি। ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ এই ছয় বছরে দেশে মোট ৬৯ টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। তবে দেশের প্রাণি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, গত দুই বছরেই ৩৮টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২২টি ও ২০২১ সালের সাড়ে ১০ মাসে ১৬টি। এর মধ্যে অধিকাংশই খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে।
গত একসপ্তাহে সারাদেশে ৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার কক্সবাজারের চকরিয়ায় হারবাংয়ের পাহাড়ী উপত্যকায় একটি এশিয়ান মৃত হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। হাতিটিকে বৈদ্যুতিক শর্ট দিয়ে মেরে পুঁতে ফেলে স্থানীয় কৃষকরা।
শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পূর্বচাম্বল ছোটবিল এলাকা থেকে একটি এশিয়ান হাতির মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ।
গত সপ্তাহে কক্সবাজারের চকরিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর একটি এশিয়ান হাতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি এবং শেরপুরের শ্রীবরদীতে একটি বন্য হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। দুটি হাতিই বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়েছিল। বনবিভাগের ময়নাতদন্তে হাতিগুলোকে হত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া। আবার কক্সবাজারের উখিয়া, চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী। এই দুটি এশিয়ান হাতির হাজার বছরের চলাচলের রুট।
তিনি বলেন, "২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে আবাসিক হাতি আছে ২৬৮টি। এর বাইরে পাশের দেশ থেকে আরো কয়েকটি হাতি আসে, আবার ফিরেও যায়। এসব হাতিসহ ৩২০-৩৩০টি হাতি আছে দেশে। এখন হত্যাযজ্ঞের কারণে হাতির সংখ্যা দ্রুত কমছে।"
ইমারজেন্সি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্য আবদুস সাত্তার বলেন, "বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নে যে হাতিটি যেখানে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে সেটি হাতির চলাচলের রাস্তা। মূলত চূনতি অভয়ারণ্যে থেকে রামদাশ হাট, হাজারীখোলা হয়ে বড় বিল-ছোটবিল ও হরিন্যাঘোনা এলাকায় নিয়মিত চলাচল করে হাতির পাল। সাধারণত এরা মানুষের ক্ষতি করে না। মানুষই বনে ঢুকে হাতির আবাস ধ্বংস করছে।"
"একসময় এই পুরো এলাকাটিই ছিল হাতির নিরাপদ ঠিকানা। কিন্তু গত ২০-২৫ বছরে হাতির আবাসভূমিতে ঢুকে মানুষ হাতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে। পাহাড়ের জমিতে চাষাবাদ করছে। সেখান থেকেই হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। কোথাও হাতির পায়ে মানুষ পিষ্ট হচ্ছে, আবার কোথাও ফসল বাঁচাতে মানুষ ফাঁদ পেতে হাতি মারছে, কোথাও গুলি করে," বলেন রফিকুল ইসলাম।
বন্যপ্রাণ বিষয়ক সাংবাদিক ও সংরক্ষণকর্মী আমিনুল ইসলাম মিঠু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতি মারা পড়ছে মানুষের পাতা ফাঁদে অথবা গুলিতে। মূলত লোভী মানুষ বনে ঢুকে গাছ ও পাহাড় কাটা হয়েছে দেদারসে। এতে হাতির নিরাপদ বাসভূমি ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রাণ হারাচ্ছে হাতি ও মানুষ।"
তিনি জানান, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইউসিএন এশিয়ান বন্য প্রজাতির হাতিকে 'মহা-বিপন্নের' তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। কিন্তু দেশের বনবিভাগ শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সেইভ দ্য নেচারের সভাপতি মোয়াজ্জেম রিয়াদ বলেন, "রোহিঙ্গারা বর্তমানে যেখানে বসতি করেছে সেটা পুরোটাই হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিলো পাঁচ বছর আগেও। এশিয়ান হাতি মিয়ানমার থেকে এই রুটেই টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশের বনে আসা যাওয়া করে। সেই রাস্তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ায় হাতিগুলো দেশের ভেতর একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আর যেগুলো পারাপারের চেষ্টা করেছে বা অন্যত্র সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেগুলোয় মানুষের হামলায় মারা পড়ছে।"
হাতির বিচরণ নিয়ে ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) গবেষণায় বলা হয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির আবাসভূমি ও চলাচলের পথগুলো নিয়মিতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গাছপালা কেটে ফসলের চাষ হচ্ছে। বনের বাইরেও ধানের চাষ বাড়ছে।
পরিবেশবাদী ও কৃষকরা বলছেন, এক সময় দেশের পাহাড়ের বন গুলোতে প্রচুর ফলজ গাছ ছিলো, সেসব খেয়েই বন্যপ্রাণিদের চলে যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অপরিকল্পিত ও কৃত্রিম বনায়নের কারণে পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন নষ্ট হওয়ায় খাবারের খোঁজে সমতল ভূমি ও লোকালয়ে আসছে হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী।
তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী টিবিএসের কাছে দাবি করেন, "সুফল প্রকল্পের আওতায় বন বিভাগ গত পাঁচ বছর ধরে বনে ফলজ গাছের চারা রোপন করছে।"
হাতির সংখ্যা নিরূপণের প্রথম তথ্য পাওয়া যায় ১৯৮০ সালে। ড. রেজা খানের জরিপ অনুযায়ী হাতি ছিল ৩৮০টি। আবার ২০০০ সালে ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের গবেষণা অনুযায়ী হাতি ছিল ২৩৯টি। ২০০৪ সালে আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭টি।
হাতি রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বন বিভাগের
হাতি হত্যার পর দৌড়ঝাঁপ শুরু করে প্রশাসনের লোকজন। সৎকার হয় হাতির দেহের। উদ্ধার হয় বিদ্যুতের তার, বল্লম। দুদিন পরই সব তৎপরতা থেমে যায়। আবারও খবর মেলে গুলিতে হাতির মৃত্যুর।
দেশে সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ টি হাতির মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত মাত্র একজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে দুটি। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রশাসনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করা বনবিভাগের সক্ষমতা ও আদৌ এই সংস্থাটি হাতি সংরক্ষণে আন্তরিক কিনা উঠছে এমন প্রশ্নও। তবে সংস্থাটি বলছে, জনবল ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার অভাবে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না হাতি বা বন্যপ্রাণী হত্যা মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা।
সেইভ দ্য নেচারের সভাপতি মোয়াজ্জেম রিয়াদ বলেন, "বন্যপ্রাণী রক্ষায় আইন আছে। কিন্তু এসব আইনের প্রয়োগ হয় না। এখানেও ঢিলেমি করা হয়। ফলে যারা বন্যপ্রাণী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে।"
তার মতে, হাতি রক্ষা করতে বনের জায়গা দখল করে যে চাষবাষ হচ্ছে, বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে সেগুলো উচ্ছেদ করে বনের জায়গা বনকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
আইইউসিএন'র হাতি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, "হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বের যে স্থানগুলো আছে সে জায়গায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। হাতি চলাচল থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণীর জন্য সঠিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে।"
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান মোল্লা রেজাউল করিম রোববার চট্টগ্রাম সফরকালে টিবিএসকে বলেন, "হাতি চলাচলের পথ দখল করে মানুষ বাড়িঘর করছে, ফসলের ক্ষেত করছে। সরকারও বিভিন্ন সময় বনের জমি মানুষকে ইজারা দিচ্ছে। একারণে হাতি ও মানুষের কনফ্লিক্ট দিনদিন বাড়ছে।"
"বনবিভাগ হাতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থদেরও সহায়তা দিচ্ছে। প্রায় তিনকোটি টাকার ফান্ড এখনো আমাদের হাতে অব্যবহৃত আছে। অন্যদিকে বন্যপ্রাণি সুরক্ষায় আমরা হাজার হাজার মামলা করেছি। কিন্তু সেসব মামলা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না। পরিবেশকে রক্ষা না করে শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন সুষম উন্নয়ন নয়।"- যোগ করেন মোল্লা রেজাউল করিম।