কর্ণফুলী চরে পুত্রজায়ার আদলে হবে প্রশাসনিক হাব
কর্ণফুলী নদীর তীরে জেগে ওঠা চরে দেশের প্রথম সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ১১০ একর জায়গার নির্মিত হবে এই অবকাঠামো, যা প্রায় ৮৩টি ফুটবল মাঠের সমান।
মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার আদলে পরিকল্পিত এই কমপ্লেক্সের নাম দেওয়া হয়েছে 'মিনি সেক্রেটারিয়েট ফর চট্টগ্রাম'। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউজসহ এখানে প্রায় ৪৪টি সরকারি অফিস থাকবে।
চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও ওয়ার্ডের বন্দর মৌজার আগামী তিন থেকে চার বছরে সরকারি সমন্বিত এ অফিস ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
চলতি মাসের শেষ দিকে এই প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই বৈঠকে প্রকল্পের নকশা ও ডিপিপিসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান।
পরীর পাহাড়কে বাঁচাতে সরছে সরকারি অফিস
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পরীর পাহাড় আইনজীবী সমিতির নতুন দুটি ভবন নির্মাণ নিয়ে দুইমাস আগে জেলা প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতির দ্বন্দ্বের শুরু হয়। এরই মধ্যে পরীর পাহাড়ের ১৩০ বছরের পুরোনো দুতালা আদালত ভবনটিকে হেরিটেজ ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি পরীর পাহাড়কে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের প্রস্তাব বিবেচনার কথা জানিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ইতোমধ্যে পরীর পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই ওই পাহাড়ে থাকা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান বলেন, "প্রায় সাড়ে তিনশ অবৈধ স্থাপনার চাপে পরীর পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই পাহাড়টির যে ভার নেওয়ার কথা, বর্তমানে তার্চেয়ে চারগুণ বেশি ভার বইছে। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, পরীর পাহাড়ে থাকা সরকারি অফিসসমূহ সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে ঐতিহাসিক পরীর পাহাড়ের সঙ্গে পুরোনো স্থাপনাগুলোও রক্ষা পাবে।"
দেশের প্রথম সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স হবে চট্টগ্রামে
পরীর পাহাড়ে থাকা চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং নগরীর অন্যত্র থাকা সরকারি দপ্তর মিলিয়ে মোট ৪৪টি সরকারি অফিস যাবে কর্ণফুলী নদীর তীরে জেগে উঠা হামিদ চরে। ইতোমধ্যেই প্রস্তাবিত সমন্বিত অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত করেছে জেলা প্রশাসন।
চট্টগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠছে 'মিনি সেক্রেটারিয়েট ফর চট্টগ্রাম' নামের এই প্রকল্প। এখানে ৪৪টি সরকারি দপ্তর ছাড়াও সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, সার্কিট হাউজ, সরকারি ট্রেনিং সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার, শপিং মল, মাল্টি স্টোরেড কার পার্কিং, সরকারি স্কুল-কলেজ, নার্সিং ইন্সিটিটিউড, পরিবহন পুল, পেট্রোলপাম্প, স্মৃতিসৌধ, নভোথিয়েটার ও মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা থাকবে।
নগরের চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামনুন আহমেদ অনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সমন্বিত অফিস কমপ্লেক্সটি হবে 'চট্টগ্রামের মিনি সেক্রেটারিয়েট'। সেখানে মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার আদলে একটি আধুনিক নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। যেখানে চট্টগ্রামের মানুষ এক ছাতার নিচে সব ধরনের সরকারি সেবা পাবেন।"
"সাধারণত সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হয় জমি অধিগ্রহণ। কিন্তু এই প্রকল্পে সেই ঝামেলা নেই। সম্পূর্ণ খাস জমিতে হওয়ায়, এটি হবে সবচেয়ে সাশ্রয়ী একটি প্রকল্প। বর্তমানে প্রকল্পটি ডিপিপি প্রণয়নের পর্যায়ে আছে," যোগ করেন মামনুন আহমেদ।
বুধবার সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কালুরঘাট সেতুর এক কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির পাশের ৭৩ দশমিক ৪২ একর জমিতে ইতোমধ্যেই চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ করেছে জেলা প্রশাসন। একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী আর অন্যপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে মেরিন ড্রাইভ সড়কের নির্মাণকাজ। এরমাঝে স্নিগ্ধ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্বাচন করা হয়েছে প্রকল্পটির স্থান ।
প্রায় এক শতাব্দী আগে কর্ণফুলী বিধৌত পলিতে হামিদ চর নামের ভূখণ্ডটি জেগে ওঠে। বছর পাঁচেক আগেও সরকারি এই খাস জমিতে ধান ও সবজি চাষ করতেন স্থানীয়রা। বর্তমানে জেলা প্রশাসনের দখলে রয়েছে চরের ৭৩ দশমিক ৪২ একর জমি। এর বাইরে আশপাশের জমিগুলো নিয়ে মামলা মোকাদ্দমা রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান হলে প্রকল্পের মোট জমির পরিমাণ ১১০ একরে দাঁড়াবে বলে আশা করছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে প্রায় ৮০ একর ও পরবর্তীতে আরও ৩০ একর মিলিয়ে মোট ১১০ একর জমির ওপর দেশের প্রথম সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে।"
"এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৩৩টি সরকারি অফিস লিখিতভাবে তাদের নিজস্ব ভবন না থাকার কথা জানিয়েছে। এছাড়া আরও ১১টি অফিসের নিজস্ব ভবন থাকলেও সেগুলো জরাজীর্ণ বা ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। সব মিলিয়ে ৪৪টি সরকারি অফিসকে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে," যোগ করেন জেলা প্রশাসক।
আগামীর চাহিদা মাথায় রেখে গড়ে উঠবে "মিনি সেক্রেটারিয়েট-চট্টগ্রাম"
জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, শুধু ৪৪টি সরকারি অফিসই নয়। আগামী ৪০ বছরে কোনো সরকারি অফিসের যদি নিজস্ব ভবনের প্রয়োজন হয়, তাহলে যেন তারাও প্রকল্প এলাকায় নিজেদের ভবন করতে পারেন, সেভাবেই বর্তমান নকশা পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামনুন আহমেদ অনিক বলেন, "প্রতিনিয়ত সরকারের বিভিন্ন ধরনের ডিপার্টমেন্ট বাড়ছে। এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, সে সব ডিপার্টমেন্টের নতুন অফিস করার জন্য সরকারকে আর অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে না।"
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান বলেন, "প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য বর্তমানে দুটি রাস্তা রয়েছে। তবে আগামী ৫০ বছরের নাগরিক সুবিধাকে মাথায় রেখে ভবিষ্যতের এই সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্সে যেতে মেরিন ড্রাইভ ও লিংক রোডসহ মোট পাঁচ ধরনের বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে।"
প্রাকৃতিক পরিবেশ অটুট রেখে দুর্যোগ সহনীয় ব্যবস্থাপনা
কর্ণফুলীর চরে গড়ে উঠতে যাওয়া সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স তৈরির লক্ষ্যে ইতোধ্যেই ভূ-তাত্ত্বিকসহ সকল ধরনের জরিপ শেষ হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, এই চরের প্রাকৃতিক পরিবেশ অটুট রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, "প্রকল্প এলাকাটি নদী তীরবর্তী হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় করে গড়ে তোলা হবে। নদী তীরকে বেড়িবাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত করা হবে। অপরদিকে শহর প্রান্ত দিয়ে যাতে কোনো ধরনের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সে জন্য পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম রাখা হয়েছে।"
তবে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ উপকূলীয় এলাকা। প্রতিবছরই এখানকার সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। এ অবস্থায় নদীর চরে সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন উচিত হবে বলে আমি মনে করি না।"
সুফল পেতে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারি দপ্তরের অফিসগুলো শহরের মাঝখানে হওয়ায় জনগণের চাপ শহরে মারাত্মক আকার নেয়। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামের সরকারি অফিসগুলোকে শহরের একপাশে কেন্দ্রীভূত করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা আশাব্যঞ্জক।"
তবে সকল সরকারি দপ্তর একসঙ্গে হলে কমপ্লেক্স এলাকায় জনচাপ ও যানবাহনের চাপ বেড়ে গিয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন তিনি। এ সমস্যা এড়াতে শুধুমাত্র ইন্টার-রিলেটেড অফিসগুলোকে এক জায়গায় নেওয়া উচিত হবে বলেও মত দিয়েছেন এই প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ।
প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, "ভবিষ্যতে প্রকল্প এলাকাকে ঘিরে তৈরি হতে যাওয়া অবকাঠামো, যানবাহন ও জনগণের চাপের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।"