করোনা সংক্রমণ কমলেও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, ঝুঁকিতে শিশুরা
দেশে করোনা মহামারির মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। গত কয়েকদিনে দেশে করোনার সংক্রমণ কমলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু সংখ্যা বেড়েই চলছে। এ মাসের ২৭ দিনেই মারা গেছেন ২৮ জন। ঊর্ধ্বমুখী এই আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার জনমনে বাড়াচ্ছে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো বছরজুড়ে মশক নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং এডিস মশা সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় এ সংক্রমণ বাড়ছে। এজন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করছেন তারা। শিশুদের জন্য করোনাভাইরাসের চেয়ে ডেঙ্গু বেশি বিপজ্জনক বলছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এ বছর আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩০৪ জনে। চিকিৎসা শেষে এ বছর হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ৮২৩০ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে চলতি মাসের ২৭ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ৬৬৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী যা পুরো বছরে আক্রন্তের প্রায় ৭১%।
বর্তমানে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, এ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯০৫ জন এবং রাজধানীর বাহিরের জেলাগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১২৭ জন ডেঙ্গু রোগী।
দুই সিটির ব্যর্থতাকেই দুষছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের লক্ষ্যে মশক নিধনে চিরুনি অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও এর তেমন কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে বিভিন্ন ভবন ও বাসাবাড়ির মালিকদের জরিমানা হয় কয়েক লাখ টাকা।
তবে এ কার্যক্রমকে এখন শুধুমাত্র 'আইওয়াশ' হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা যদি এ বছরের প্রথম থেকেই এডিস মশা সম্পর্কে সচেতন হতো ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, তবে ডেঙ্গু এভাবে মহামারি আকারে ছড়াতো না।
এ বিষয়ে ঢাকা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এডিস মশার সংক্রমণের আগ থেকে যদি সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগী হতেন তাহলে ডেঙ্গুর এ খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না। এখন মশার ওষুধ ছিটিয়ে তেমন কোনো লাভ হবে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন থেকে যতোটুকু সংক্রমণ এড়ানো যায়"।
আগামী ২/৩ সপ্তাহ পরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমা শুরু করবে উল্লেখ করে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেন, "বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গুর সংক্রমণ পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি সাধারণত ২ থেকে ২.৫ মাস ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি থাকে এরপরে কমতে থাকে। সেক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের মাঝে গিয়ে সংক্রমণ কমতে শুরু করবে"।
সিটি করপোরেশনের অপেশাদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় কীটতত্ত্ববিদ না থাকাকে দায়ী করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "একেকটা সিটি কর্পোরেশন ২/১ জন কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে চলছে আর যারা মশক নিধনে কাজ করে তাদের পেশাদারিত্ব নেই। মশক কর্মী দিয়ে কিংবা ক্লিনার দিয়ে এডিস মশার সংক্রমণ কমানো সম্ভব নয় যদি কীটতত্ত্ববিদদের সঠিক পযালোচনা না থাকে"।
আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার বেশি
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে শিশুদেরই মৃত্যুর হার বেশি হাসপাতালগুলোতে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর শিশুরা আক্রান্ত হয়ে সংকটাপন্ন হয়ে মৃত্যুও হচ্ছে বেশি।
শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ভর্তি হয়েছে ৪১০টি শিশু যাদের মধ্যে ১০০ জনের অধিক সংখ্যককে আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি আছে মোট ৬১টি শিশু।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ টিবিএসকে বলেন, "ডেঙ্গু যতবারই এসেছে ততবারই শিশুরা বেশি সংক্রমিত হয়েছে। এ বছর এ পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৭টি শিশু মারা গিয়েছে। এখন আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছে ৭টি শিশু। শিশু হাসপাতালে মোট শিশুর ৬৫% ডিএনসিসির, ২২% ডিএসসিসি, ১২% ঢাকার বাইরের"।
তিনি আরও বলেন, পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেই বেশিরভাগ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।
ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ লাখের অধিক!
বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর যে সংখ্যা বলছে, প্রকৃত রোগী তার অন্তত ২০ গুণ বলে কীটতত্ত্ববিদের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন দেশে ২ লাখেরও অধিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও ঢাকা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "সিটি কর্পোরেশন স্বীকারও করে না যে তারা যে সংখ্যা বলছে এর থেকে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তারা আর কী ব্যবস্থা নিবে"!
সাধারণ মানুষ বাসায় বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন আর সংকটাপন্ন হলেই কেবল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন এ কীটতত্ত্ববিদ।