করোনার ছোবলে ‘কোমায়’ সিলেটের আবাসন খাত

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় 'রয়্যাল সিটি' নামে একটি আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে রয়েল হোমস নামের একটি বৃহৎ আবাসন গ্রুপ। করোনা সংক্রমণ শুরুর হওয়ার পর থেকেই স্থবির হয়ে পড়েছে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা, বিক্রিও প্রায় বন্ধ। আগে বিক্রি হওয়া প্লটের কিস্তিও পরিশোধ করছেন না ক্রেতারা।
রয়্যাল সিটির চেয়ারম্যান ফয়সাল আহমদ চৌধুরী বলেন, "সিলেটের আবাসন খাতে দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্কট চলছে। বিশেষত বিশ্বমন্দা শুরুর পর থেকেই। তবে করোনা এসে পুরো আবাসন খাতকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আট মাস ধরে আমাদের বিক্রি বন্ধ। পুরনো কিস্তিও পাচ্ছি না। এমন অবস্থা আরও অনেকদিন চলবে বলেই মনে হচ্ছে।"
একই কথা জানালেন সিলেটের জিন্দাবাজারের আনন্দ টাওয়ারের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার জলিল। তিনি বলেন, "ব্যবসা বন্ধ তবে ব্যাংক ঋণ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। মুনাফার বদলে ঋণের সুদ দিতেই এখন আমরা দেউলিয়া হওয়ার পথে।"
সিলেটের আবাসন খাতের প্রায় সব ব্যবসায়ী আক্ষেপের সুরে একই কথা জানিয়েছেন। করোনার কারণে অব্যাহত লোকসানের মুখে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবছেন অনেকে। যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ তাদের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের আবাসন খাতের ক্রেতাদের বড় অংশই যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা। প্রবাসীদের উপর নির্ভর করে এই শতাব্দির শুরুর দিকে সিলেটে গড়ে ওঠে শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান। প্রবাসী বিনিয়োগও গড়ে ওঠে একইসাথে। তবে বৈশ্বিক মন্দার প্রথম ধাক্কা লাগে সিলেটের আবাসন খাতে। প্রবাসীরা বিনিয়োগ তুলে নেন। নতুন করে ফ্ল্যাট-প্লট ক্রয় বন্ধ করে দেন। এতে করে প্রায় অর্ধযুগ ধরেই ধুঁকছে সিলেটের আবাসন খাত। করোনাভাইরাস মহামারী ধুঁকতে থাকা এই শিল্পে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
সিলেটের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপ (সারেগ) সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে এই সংগঠনটির সদস্য ছিলো ১১০ টি প্রতিষ্ঠান। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে টিকতে না পেরে ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে।এখন সংস্থাটির সদস্য রয়েছে প্রায় ৫০টি। তবে করোনার লোকসানে এ বছর আরও অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যবসা গুটিয়ে নেবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিছুক সিলেটের সদর উপজেলার একটি আবাসন প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "সিলেটে আবাসন খাতের মন্দা অনেকদিন ধরেই চলছে। জমির দাম অর্ধেক কমে গেছে। ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ। ব্যাংক ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তবু কোনোরকমে এতোদিন টিকে ছিলাম। কিন্তু করোনার পর আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছি আমরা।"
সারেগের সভাপতি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, "সিলেটের আবাসনখাতের ক্রেতারা হলেন প্রবাসীরা, বিশেষত যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা। করোনায় যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে আছেন। ফলে আমাদের নতুন বিক্রি তো বন্ধ আছেই, এমনকি আগে যারা কিনেছিলেন তারাও কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। বাকিরাও সময়মত প্লট হস্তান্তর করতে পারবেন না। সবমিলিয়ে বলা যায়, সঙ্কটাপন্ন আবাসন খাত করোনার কারণে এবোরে কোমায় চলে গেছে।"
মূলত যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া, প্রবাসীদের তৃতীয় প্রজন্ম দেশের প্রতি আগ্রহী না হওয়ার কারণে সিলেটের আবাসন খাতে সঙ্কট দেখা দেয়। প্রথম দফার বিপর্যয়ের পর যুক্তরাজ্যে এখন চলছে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ। লকডাউন শুরু হয়েছে। আর করোনার এ অব্যাহত বিস্তারে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। অনেকের আয় রোজগার প্রায় বন্ধ। অর্থনীতির এই সঙ্কট আরও অনেকদিন থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা কখন দেশে বিনিয়োগে সক্ষম হবেন এ বিষয়টি পুরোই অনিশ্চিত। কাজেই সহসা আবাসন খাতের সঙ্কটও কাটবে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
সারেগের সাবেক সভাপতি হাসিন আহমদ জানান, করোনার কারণে সঙ্কট বেড়েছে তবে সিলেটের আবাসন খাতের মন্দা অনেকদিন ধরেই চলছে।
"কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও সিলেটে আবাসন ব্যবসা পরিকল্পনাহীনভাবে অনকেটা হুজুগে গড়ে ওঠেছে। যে যেখানে পেরেছেন আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। এছাড়া অনেকেই আবাসনের নামে ঋণ এনে অন্য খাতে টাকা ব্যবহার করেছেন। সেখানে লাভবান হতে না পেরে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এসব কারণেও ব্যবসায় চরম মন্দা দেখা দিয়েছে।" বলেন তিনি।