এপ্রিল মাস সবচেয়ে ‘ক্রিটিক্যাল’ যে কারণে

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের দাপটে সারা পৃথিবীর জনজীবন বিপর্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে হু-হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এ ভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশেও চলছে সাধারণ ছুটি, চলছে 'অঘোষিত' লকডাউন।
এরইমধ্যে দেশে বুধবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন মোট ২১৮ জন। এদের মধ্যে ৩৩ জন সুস্থ হয়ে গেলেও মারা গেছেন ২০ জন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এপ্রিল মাসটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একদিকে যেমন সামাজিক সংক্রমণ দেখা দিতে শুরু করেছে, তেমনি সেটি প্রতিরোধ করতে সরকার নিয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এপ্রিল কেন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে 'ক্রিটিক্যাল', চলুন সেই বিশ্লেষণ জানি বিবিসির সূত্র ধরে।
বুধবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিবিসি বাংলাকে জানান, বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের দিক থেকে করোনাভাইরাস তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের মাঝামাঝিতে রয়েছে। ভাইরাসটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়লেও সেটা এখনো ক্লাস্টার আকারে রয়েছে।
দেশে যখন কোনো রোগী শনাক্ত না হয়, সেটিকে সংক্রমণের প্রথম স্তর বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, বিদেশফেরতদের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত হলে সেটি দ্বিতীয় স্তর। আর তৃতীয় স্তর হলো সীমিত আকারে সমাজে রোগটির ছড়িয়ে পড়ার অবস্থা।

গুরুতর এপ্রিল
বুধবার দেশে নতুন করে ৫৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৪১ জন। তার আগের দিন ছিল ৩৫ জন। তাই বোঝা যাচ্ছে, দিন দিন বাড়ছে শনাক্তের সংখ্যা।
এছাড়া বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ২৪ ঘণ্টার হিসেবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন। দেশে বুধবার পর্যন্ত প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জনে।
এদিকে, সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই রাজধানীর বেশ কিছু এলাকা, নারায়ণগঞ্জ জেলা, কক্সবাজার জেলাসহ দেশের অনেক এলাকায়ই ছোট ও বড় পরিসরে লকডাউন করেছে সরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস কন্ট্রোল করতে হলে এই এপ্রিল মাসের মধ্যেই করতে হবে। এর চেয়ে বেশি সময় দেওয়া যাবে না। আমরা যদি সেটা করতে না পারি, ব্যর্থ হই, তাহলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। তখন লম্বা সময় ধরে আমাদের করোনাভাইরাস পুষতে হবে। তাই এই এপ্রিল মাসটা খুব ক্রিটিক্যাল।

রোগী বাড়ার শঙ্কা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলেন, আমরা ৩০ দিনের দিনে যে অবস্থায় আছি, ব্রাজিল ১৫ দিনের দিন সেই অবস্থায় ছিল। মানে একশো দেড়শ রোগী শনাক্ত করার হচ্ছিল। আর ভারতেও এরকম ছিল ৪৫তম দিনের দিন।
ব্রাজিলে সেই অবস্থা থেকে আজ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। আর ভারতে রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। সুতরাং ভারতের সাথেও তুলনা করলে বোঝা যায়, আমাদের রোগীর সংখ্যা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কয়েক হাজারে পৌঁছে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
করোনাভাইরাসের বিশ্বচিত্রে নজর রেখে দেখা যায়, চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে প্রথম দিকে যে হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে, চার সপ্তাহের পরপর পরিস্থিতির রাতারাতি অবনতি হয়েছে। রোগী সংক্রমণ ও মৃত্যু হারও অনেক বেড়ে গেছে দেশগুলোতে।
অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলেন, বাস্তব ক্ষেত্রে চিকিৎসক বলুন, আইসিইউ বলুন, অক্সিজেন থেরাপি বলুন, এগুলো আসলে শেষ অস্ত্র। আমাদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে লকডাউন। সেটা আমরা যতভাবে করতে পারব, স্বাস্থ্যখাতের ওপর ততই কম চাপ পড়বে।
অন্যদিকে, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রোগী বাড়ার আশঙ্কা যেহেতু আছে, তাই পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর জোর দেওয়া উচিত। শুধু করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে।
চাই সমন্বয়
বাংলাদেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলেন, এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কোথায় কোথায় গেছেন, কী করেছেন, তাদের বাড়িতে কে এসেছেন, কোন দোকানে গেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করা, সেগুলো জানা দরকার।
তিনি বলেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি খুবই জরুরি। হাসপাতালে যারা চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলোও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি হবে।