এপ্রিল বাংলাদেশের নিষ্ঠুরতম মাস
চলতি বছরের এপ্রিলে করোনায় গড়ে প্রতিদিন ৮১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ গত বছর বাংলাদেশে এই মারাত্মক মাসটিতে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১ জন। এ মাসে সংক্রমণ বাড়ায় মৃত্যুও বেড়েছে। মৃত্যু কমাতে কঠোর লকডাউনের তাগিদ দিয়ে আসছিল বিশেষজ্ঞরা। সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে 'কঠোর লকডাউন' জারিও করে। কিন্তু এ কঠোর লকডাউনে গণপরিবহন ছাড়া সবকিছুই চলছে আগের মতো। শপিংমল, সড়ক ও অলিগলিতে মানুষের ভিড় দিনদিন বেড়েই চলছে। এভাবে চলতে থাকলে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবার বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে চলমান লকডাউন বিধিগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে।
সরকার আগামী ৫ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় বুধবার এক বৈঠকে কমিটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহর, সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে বৈঠকে তারা জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বেশি করে উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। লকডাউন শেষে এর 'এক্সিট প্ল্যান' নিয়েও ভাবার পরামর্শ দিয়েছে এই কমিটি। জরুরি ভিত্তিতে এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এপ্রিল মাসের ৩০ দিনে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৩৪৭ জন, যা এখন পর্যন্ত এক মাসে করোনাভাইরাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে যখন করোনাভাইরাসের ফার্স্ট ওয়েভের পিক টাইম ছিল তখন মারা গেছেন ১২৬৪ জন। সে সময় একদিনে সর্বোচ্চ ৫৫ জন মানুষ মারা গেছে। এ বছরের এপ্রিলে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ১১২ জন। এ মাসে ৫ দিন দৈনিক মৃত্যু ১০০ এর বেশি ছিল।
চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ক্রিটিক্যাল রোগীদের মৃত্যু হয়। ৪-১২ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ দিন নতুন রোগী ৭ হাজারের বেশি ছিল। তাই আগামী সপ্তাহে মৃত্যু আরো বাড়তে পারে। মৃত্যু কমাতে হলে সংক্রমণ কমাতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'লকডাউন দিয়ে মার্কেটে-রাস্তাঘাটে ভিড় বাড়লে ও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে না। সংক্রমণ আবার বাড়বে'।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'জীবিকার কথা বলে দোকান খুলে দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেনা। ঠিকমত মাস্ক পরছেনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সংক্রমণ বাড়বে এবং মৃত্যুও বাড়বে'।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, 'করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করার জন্য লকডাউন একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এর অর্থ হলো হাসপাতাল, ওষুধের দোকান এবং অ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত সমস্ত কিছু বন্ধ থাকবে। এর সাথে সবজি বা মাছের বাজার মাত্র এক বা দুই ঘন্টার জন্য খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হবে'।
'তবে আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। সবকিছু খোলা রেখে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে সরকার বা জনগণের কেউই উপকৃত হবে না', যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমল, নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়া, নূর ম্যানশন, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে দিনের পর দিন লোক সমাগম বাড়ছেই। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানার তেমন একটা গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকে ঠিকমতো মাস্কও পরছেনা।
চাদঁনী চক দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নিজাম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিদিনই আমরা দোকান মালিক ও বিক্রয় কর্মীদের সঠিকভাবে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করে যাচ্ছি। কাস্টমারদেরও মাস্ক না পরা থাকলে মাস্ক পরার অনুরোধ করছি'।
এছাড়াও রাজধানীতে প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় সড়কে ভিড় এবং যানজট বেড়ে চলছে। বৃহস্পতিবারও রাজধানীর পান্থপথ সিগন্যালে তীব্র জ্যাম দেখা গেছে। কারওয়ান বাজার, সায়েন্স ল্যাব,নীলক্ষেত,শাহবাগ মোড়সহ রাজধানীর অনেক জায়গায় ছিল যানজট। শপিংমল ও দোকানপাট খুলে দেয়ার পর থেকেই রাস্তায় 'মুভমেন্ট পাস' এর জন্য পুলিশের চেকিং কোথাও আর তেমন চোখে পরেনি। আইশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টগুলোর সব প্রায় তুলে নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে রমনা জোনের ট্র্যাফিক সাজেন্ট মোরশেদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'রাস্তায় এত লোক সমাগম আসলে এখন আর চেক করে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না, দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও মুভমেন্ট পাসের জন্য চেকিং করতে গেলেই রাস্তায় তীব্র যানজট বেঁধে যাচ্ছে'।
করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, 'আমরা সব সময় বলেছি লকডাইন হলে শুধু ইমারজেন্সি কাজ ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। কিন্তু সেটা হয় নি। পুরোপুরি লকডাউন করা হলে সর্বোচ্চ ফল পেতাম। তাহলে জুনে আমাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় পৌঁছত। ঈদের ছুটিতে মানুষের মুভমেন্ট আরো বাড়লে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে'।
তিনি বলেন, 'অন্য খাতের চেয়ে তৈরী পোশাক শিল্পের মালিকরা ভালোভাবে স্বাস্থ্য বিধি মানেন। তারা কর্মীদের স্বাস্থ্যবিধি শিখিয়েছেন। তাদের সংক্রমণ হার কম। আরএমজির মতো আমাদের দোকান মালিক সমিতিকে বারবার বলেছিলাম যখন খোলা হবে আপনারা নিশ্চিত করবেন প্রতিটি দোকানে স্বাস্থ্যবিধি যেন মানা হয়, মাস্ক না পরে ক্রেতা আসলে তার কাছে যেন বিক্রি না করা হয়। কিন্তু তারা এসব মানছে না'।