আড়াই বছর ধরে অলস পড়ে আছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল
- ২০১৮ সালের ১লা নভেম্বর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন হয়
- চিকিৎসক-জনবলের অভাবে বহির্বিভাগ ছাড়া সকল সেবা বন্ধ
- উদ্বোধনের দুই বছর পর একটি এক্স-রে মেশিন ও অস্ত্রোপচার টেবিল-লাইট দেয়া হয়েছে
প্রায় আড়াই বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়েও পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু হয়নি আধুনিক অবকাঠামোর এই হাসপাতালটিতে। চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাবে কার্যত অলস পড়ে আছে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালটি। প্যাথলজি, জরুরি ও অন্তঃবিভাগ চালু না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের চম্পকনগর গ্রামের আখাউড়া-চান্দুরা সড়কের পাশে ৩ একর জায়গায় ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে শেষ হয় নির্মাণ কাজ। এরপর ওই বছরের ১লা নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন করেন।
চারতলা বিশিষ্ট আধুনিক অবকাঠামোর এই হাসপাতালটিতে শিশু ওয়ার্ড, মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডসহ কেবিন এবং অস্ত্রোপচার কক্ষও রয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই ব্যবহৃত হচ্ছে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাবে। হাসপাতালটিতে চিকিৎসকদের জন্য কোয়ার্টারও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে বর্তমানে শুধুমাত্র বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। বহির্বিভাগ থেকে রোগীদের ছোট-খাটো রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু প্যাথলজি, জরুরি ও অন্তঃবিভাগ চালু না হওয়ায় রোগীরা পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি অনেকটা অলস পড়ে থাকায় গত বছর এটিকে জেলার প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
উদ্বোধনের দুই বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে একটি এক্স-রে মেশিন, একটি অস্ত্রোপচার টেবিল ও একটি লাইট এবং দুইটি ডেলিভারী টেবিল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু জনবলের অভাবে এক্স-রে মেশিনটি এখনও পর্যন্ত এক্স-রে কক্ষে বসানোই হয়নি। এছাড়া সার্জন না থাকায় অস্ত্রোপচার টেবিল-লাইটও কোনো কাজে আসছে না। আর দুই দফায় বেড এসেছে ৪০টি। এর মধ্যে ২০টি বেডের ম্যাট্রেস নেই। কিন্তু অন্তঃবিভাগ চালু না হওয়ায় এসব জিনিসপত্রও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
উদ্বোধনের প্রায় আড়াই বছর পার হতে চললেও বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত কেবল একজন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও), একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), দুইজন ডেন্টাল সার্জন ও পাঁচজন সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদায়ন হয়েছে।
অবশ্য একজন ডেন্টাল সার্জনকে প্রেষণে এখানে পদায়ন করা হয়েছে। কিন্তু ডেন্টাল বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় ডেন্টাল সার্জনরা কোনো কাজ করতে পারছেন না। হাসপাতালের অন্তঃবিভাগ চালু না হওয়ায় নার্সরাও অলস সময় পার করছেন।
অথচ হাসপাতালটিতে ইউএইচএফপিও এবং আরএমও পদ ছাড়াও দুইজন সহকারী সার্জন, একজন ডেন্টাল সার্জন, দুইজন জুনিয়র কনসালটেন্ট, সাতজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, চারজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন প্রধান সহকারী, একজন হিসাব রক্ষক, একজন কোষাধ্যক্ষ ও একজন অফিস সহকারীর অনুমোদিত পদ রয়েছে। কিন্তু উদ্বোধনের প্রায় আড়াই বছরেও এসব জনবল নিয়োগ- পদায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গভাবে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু করতে অনুমোদিত পদের সকল চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ এবং আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ও প্যাথলজি ল্যাবের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রয়োজন। এগুলো না হলে পূর্ণাঙ্গ সেবা কার্যক্রম চালু করা সম্ভব নয়।
বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও মো. আশরাফুল আলম বলেন, 'আমাদের এখানে সব ধরণের রোগীই আসেন, আমরা সীমিত জনবল ও সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। বড় কিছু হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠিয়ে দেই। হাসপাতালের জরুরি ও অন্তঃবিভাগটি চালু হলে রোগীরা সব ধরণের সেবা পাবেন এখানে। হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর জন্য চেষ্টা চলছে'।
আড়াই বছরেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালটির সকল সেবা কার্যক্রম চালু করে তাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ দূর করার দাবি জানিয়েছেন।
বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন বলেন, 'আমার ছেলের টনসিল সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন অপারেশন করতে হবে। কিন্তু এখানে অপারেশন হবেনা। হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে আমাদের আর কষ্ট করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে যেতে হতো না'।
হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামের বাসিন্দা জহিরুল আলম চৌধুরী জানান, বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখানকার মানুষের বহুল প্রত্যাশিত। কিন্তু আড়াই বছরেও হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু না হওয়ায় এখানকার মানুষকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর ও হবিগঞ্জের মাধবপুরে দৌঁড়ঝাপ করতে হয়। তাই দ্রুত হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা প্রয়োজন।
হরষপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক মনিরুল ইসলাম জানান, পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হওয়ার ফলে মানুষ হাসপাতাল থেকে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা। এর ফলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি মানুষের তেমন কাজে আসছে না। সেজন্য দ্রুত পূর্ণাঙ্গ সেবা চালুর দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মো. একরাম উল্লাহ বলেন, 'আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে চিঠি চালাচালি করেছি। এর প্রেক্ষিতে কিছু জনবল নিয়োগ হয়েছে। আরও কিছু বাকি আছে। অতি সম্প্রতি চিকিৎসক ও নার্সসহ কিছু জনবল পদায়ন হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালের অন্তঃবিভাগ চালু করতে পারব। অন্তঃবিভাগটি চালু হলে পুরো বিজয়নগরবাসী পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতালের সেবার আওতায় আসবেন'।