আলু ছেড়ে সরিষা চাষে রংপুরের কৃষক

অব্যাহত লোকসানের কারণে আলু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সরিষা চাষে ঝুঁকছেন রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা। অল্প জমিতে কম পরিশ্রম করেই খরচের প্রায় তিনগুণ লাভ থাকায় ভাগ্য বদলাতে সরিষাকেই বেছে নিয়েছেন তারা। স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, ধান ও সরিষার একটি শস্য বিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদ করলে উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি লাভেরও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। তারাও সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছন।
কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র বলছে, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় প্রায় পৌঁনে তিন লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাজারে আলুর দাম না থাকায় কৃষক এর চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলুর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের চাষীরা গত কয়েক বছর ধরে সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। প্রথমে বিনাধান-৭, এরপর বিনা সরিষা-৭ এবং সবশেষে বোরো ধান- এই শস্য বিন্যাস অনুসরণের মাধ্যমে সরিষার চাষ করে খুব কম সময়ে ভালো ফলন পাওয়ায় আশাবাদী কৃষকরা। আমন মৌসুমে আষাঢ় মাসে আগাম জাত বিনা ধান-৭ এর চাষ করে আশ্বিনের শেষ দিকে কর্তন করে সাফল্যজনক ভাবে বিনা সরিষা-৭ চাষ করা যায়। সরিষা কর্তন করে স্বাভাবিকভাবেই করা যায় বোরো ধানের চাষ। এতে আমন এবং বোরো ধানের ফলনও ভাল হয়। বিনা সরিষার একর প্রতি ফলন ২৮ মন এবং গড় ফলন হয় ২২ মন। প্রতি মণ সরিষা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হওয়ায় চাষীরা প্রতি একরে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
তিন বছর আগেও নিয়মিত আলুর চাষ করতেন রংপুরের পীরগাছার চ-ীপুর গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া। তবে কয়েকবছর অব্যাহত লোকসানের কারণে শুরু করেন সরিষার চাষ। গত দুই বছর ধরে সরিষায় ঘুরেছে তার ভাগ্য।
গত আট বছর ধরে আলুর পাশাপাশি সরিষার চাষ করছেন জানিয়ে পীরগাছার দেউতি এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে বাজারে সরিষার দাম ভাল থাকায় এবার আমি তিন বিঘা জমিতে হাইব্রিড-৭ জাতের সরিষা চাষ করেছি। এ পর্যন্ত আমার খরচ হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। আশা করছি খরচ বাদ দিয়ে আমার দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হবে।’’

আলু চাষের চেয়ে সরিষায় খরচ কম জানিয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার ধাপ শ্যামপুর গ্রামের সামছুল আলম বলেন, ‘‘আড়াই বিঘা জমিতে দেশি সরিষার চাষ করতে এখন পর্যন্ত আমার ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে ৮০ থেকে ৮৫ মণ সরিষা উৎপাদন হবে। খরচের চেয়ে তিনগুণ বেশি লাভ হবে বলে আশা করছি।’’
অন্যদিকে চাষিরা গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করেছেন এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায়। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের ১৬ জেলায় ২০১২ সালে রংপুরসহ উত্তরের এক লাখ ৩২ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। এই পরিমাণ ২০১৩ সালে এক লাফে উঠে দাঁড়ায় দুই লাখ ৪৯ হাজার ১৭৮ হেক্টরে। ২০১৪ সালে সরিষার আবাদ হয়েছে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫৪ হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে আবাদ হয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। ২০১৬ সালে এর পরিমান বেড়ে দাড়ায় দুই লাখ ৭৮ হাজার ৭২০ হেক্টরে। ২০১৮ সালে আবাদ হয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে। ২০১৯ সালে তা দাড়িয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ হেক্টরে।
রংপর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম জানান, চলতি বছর (২০২০ সাল) রংপুর জোনের ৫ জেলায় ৩৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে।
আঞ্চলিক কৃষি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চলতি বছর রংপুর অঞ্চলে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন। গত বছরের মতো বাজার থাকলে যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকার উপরে। যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে করবে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমি সরিষা চাষের উপযোগী। পরিকল্পিতভাবে এই সরিষা চাষ করতে পারলে উত্তরাঞ্চল থেকেই দেশের অর্ধেকেরও বেশি সরিষার তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান জানান, গত বছরের চেয়ে চলতি বছর এ অঞ্চলে সরিষার চাষ ও ফলন উভয়ই বেশি হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও ঝুকছেন সরিষা চাষে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে চাষ হয়েছে সরিষা। কৃষি অফিস থেকেও সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।