আজি হতে শতবর্ষ আগে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ

১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর। হেমন্তের শীত শীত সকাল। চারদিকে কুয়াশার আঁধার। কুয়াশার ভেতর থেকেই যেন একটা ট্রেন এসে থামল সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে। প্রতিদিনই যেমন থামে। তবে এই ট্রেন থেকে নেমে আসলেন দীর্ঘ শুভ্রকেশ আর শ্মশ্রুমণ্ডিত বিশেষ একজন। ছয় বছর আগে যিনি উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল জয় করেছেন। অবশ্য গান আর কবিতায় আরও আগেই তিনি জয় করে নিয়েছেন বাঙালির হৃদয়। শ্রীহট্টে পা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বছর রবীন্দ্রনাথের সিলেট পরিভ্রমণের একশ’ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
সিলেটে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুর এই সফর নিয়ে প্রখ্যাত সম্পাদক নলিনীকুমার ভদ্র লিখেন “কবির জীবনী থেকে এ তিনটি দিনের কাহিনী (সিলেট ভ্রমণের ৩ দিন) বাদ দিয়ে যদি কোনো শ্রীহট্টের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে তা হবে অসম্পূর্ণ। অনাগত যুগে আমাদের ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা এ কাহিনী পড়ে গর্ব অনুভব করবে- যদিও ঈর্ষা করবে তারা আমাদের অপরিসীম সৌভাগ্যকে।”
গর্ব আর ঈর্ষাজাগানিয়া সেই স্মৃতির স্মরণে এবার সিলেটে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য রবীন্দ্রনাথের পরিভ্রমণের একশ’ বছর পূর্তি পালন করা হচ্ছে। ‘শ্রীহট্টে রীবন্দ্রনাথ: শতবর্ষে স্মরণোৎসব’ শিরোনামে তিনদিনব্যাপী এই আয়োজন শুরু হবে আজ মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর)। এছাড়া রবীন্দ্রস্মৃতিবাহী সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজ, ব্রাহ্ম সমাজ, সিংহ বাড়ি ও মাছিমপুর মণিপুরী মন্দিরে পৃথক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
সিলেট ভ্রমণের আনন্দ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসবিদ ও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কালিদাস নাগকে ১৯১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর এক চিঠিতে লেখেন-
“আশ্রমে ফিরে এসেছি। পাহাড় (শিলং) থেকে নেমে আসবার পথে গৌহাটি, শিলেট (সিলেট) ও আগরতলা ঘুরে এলুম। বলা বাহুল্য বক্তৃতার ত্রুটি হয়নি। দিনে চারটে করে বেশ প্রমাণসই বক্তৃতা দিয়েছি এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এমনতর রসনার অমিতাচারে আমি যে রাজী হয়েছি তার কারণ ওখানকার লোকেরা এখনও আমাকে হৃদয় দিয়ে আদর করে থাকে এটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলুম। বুঝলুম কলকাতা অ লের লোকের মত ওরা এখনো আমাকে এত বেশি চেনেনি ওরা আমাকে যা-তা একটা কিছু মনে করে। তাই সেই সুযোগ পেয়ে খুব করে ওদের আমার মনের কথা শুনিয়ে দিয়ে এলুম। -(চিঠিপত্র-১২)
সিলেটে ভ্রমণকালে ৬ নভেম্বর টাউন হল প্রাঙ্গণে ও ৭ নভেম্বর মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের উদ্যোগে কবি-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দুটি বক্তৃতা দেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীতে টাউন হলের বক্তৃতা ‘বাঙালীর সাধনা’ নামে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আর এমসি কলেজের বক্তৃতার সারমর্ম ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে শান্তিনিকেতন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

এমসি কলেজের বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেচ? মহৎ আকাক্ষা। তোমারা বিদ্যালয়ে শিখবে বলে ভর্ত্তি হয়েচ। কি শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখী তার বাপ মায়ের কাছে কি শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কি করে বড় করে আকাক্সক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে। এ শেখাবার জন্যে বেশী সাধনা দরকার নেই; কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে এই শিক্ষার জন্যে যে অপরিমিত আকাক্সক্ষার দরকার তাকেই শেষ পর্য্যন্ত জাগিয়ে রাখবার জন্যে মানুষের শিক্ষা।”
তিনি বলেন, “যে দেশে বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোটবুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টিভিক্ষা করচে, কিংবা পরীক্ষার পাশের দিকে তাকিয়ে টেক্সট্ বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত, যে দেশে মানুষের বড় প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রেই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে লোকে দেশকে কিছুই দিচ্চে না - না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি; যে দেশে কর্ম্মের ক্ষেত্র সংকীর্ণ কর্ম্মের চেষ্টা দুর্ব্বল, যে দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণমন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করচে না; যে দেশে অভ্যাসে বন্ধনে সংস্কারের জালে মানুষের মন এবং অনুষ্ঠান বদ্ধ বিজড়িত; যে দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা নূতন করে চিন্তা করা ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল হাতের যে নেই তা নয় সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে মানুষ আপন সমাজে আত্মাকে দেখতে পায় না, কেবল হাতকড়া, পায়ের বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জ্জনারাশিকেই চারিদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকেই দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।”
ভ্রমনকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে সিলেটকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেন রবীন্দ্রনাথ। সেসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে আক্ষেপও ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। শতবর্ষ পরেও সিলেটের বর্ণণা দিতে গিয়ে এখনও অনেকেই দ্বারস্থ হন সেই কবিতার।-
“মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।/ ভারতী আপন পুণ্য হাতে/ বাঙালির হৃদয়ের সাথে/ বাণীমালা দিয়া/ বাঁধে তব হিয়া/ সে বাঁধনে চিরদিনতরে তব কাছে/ বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা আছে।”

এই কবিতা থেকে ধার করে সিলেটকে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন কেউ কেউ।
লেখক ও রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্র লাল দাশ বলেন, রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র সিলেটকে নিয়েই কবিতা লিখেছেন। অন্যকোন স্থান সম্পর্কে কোথাও কবিতা লিখেছিলেন কি না জানা যায় না। রবীন্দ্র হস্তাক্ষরে লেখা কবিতাটির শিরোনাম ছিল না। তারিখও ছিল না। স্থান নামও ছিল না। পরে কবিপ্রণামে ‘শ্রীভূমি’ নামে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্র গবেষকদের অনুমান ১৯৩৬ সালে এই কবিতা রচিত হয়েছিল।
সিলেটে এসে মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। মণিপুরী কাপড়ও তাকে মুগ্ধ করে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা তাঁর ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ :শতবর্ষে ফিরে দেখা’ প্রবন্ধে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি নৃত্যকলায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, কলকাতায় ফিরবার পথে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য নিয়ে একজন নাচের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান সেখানকার শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাবার জন্যে।
সিলেটে এবার রবীন্দ্র স্মরণোৎসব মহাসমারোহে পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দীর্ঘদিন ধরেই অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে রবীন্দ্রস্মৃতিচিহ্নগুলো।

সিলেট ভ্রমণকালে নগরীর নয়াসড়কের মিশনারি বাংলোয় (পাদ্রী বাংলা নামে পরিচিত) থাকার ব্যবস্থা হয় রবীন্দ্রনাথের। এই বাংলোটির এখন আর অস্তিত্বই নেই। খ্রিস্টান মিশনারি নেতারা বাংলোসহ ওই জায়গাটি অনেকটা গোপনে বিক্রি করে দেন। বর্তমানে সেখানে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে।
নগরীর চৌহাট্টা এলাকার এতিহ্যবাহী সিংহ বাড়িতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ বাড়িটিকে অর্পিত সম্পত্তি উল্লেখ করে একটি প্রভাবশালী মহলকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে আন্দোলনের মুখে পরে বন্দোবস্ত বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। এমসি কলেজেও নেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার মতো কোনো উদ্যোগ।
সিলেট ভ্রমণকালে নগরীর বন্দরবাজারের ব্রাহ্মমন্দিরে দুইবার যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে সমবেত প্রার্থনায়ও অংশ নেন। ব্রাহ্মমন্দিরটি এখন জরাজীর্ণ অবস্থয় কোনোরকম টিকে আছে।

রবীন্দ্রনাথের মন কেড়েছিল সিলেটের মণিপুরী নৃত্য। নগরীর মাছিমপুরের মণিপুরি পল্লীর ম-পে বসে নৃত্য দেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের দাবির পর গত বছর এই ম-প প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ মুর্তি স্থাপন করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এটি নিয়েও আপত্তি জানায় মৌলবাদী গোষ্ঠী।
কবি তুষার কর বলেন, কেবল গান বাজনা আর লোক দেখানো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র স্মরণ নয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্নগুলোও আমাদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তাতে আগামী প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে পারবে।
রবীন্দ্রনাথের সিলেট পরিভ্রমণের একশ বছর পূর্তিতে ‘শ্রীহট্টে রীবন্দ্রনাথ: শতবর্ষে স্মরণোৎসব’ পালনে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে আহ্বায়ক ও সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটির সদস্য সচিব আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ৫ নভেম্বর আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। রবীন্দ্রনাথ নৌকায় করে সুরমা নদী পার হয়ে চাঁদনীঘাটের সিড়ি দিয়ে সিলেটে প্রবেশ করেছিলেন। এই চাঁদনীঘাটের সিঁড়িতেই আমরা প্রথম দিনের অনুষ্ঠান করবো। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সিলেট নিয়ে কবিতা দিয়ে একটি মুর্যালও উন্মোচন করা হবে। মূল অনুষ্ঠান হবে ৭ ও ৮ নভেম্বর সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের লেখক, রবীন্দ্র গবেষক ও শিল্পীরা অংশ নেবেন।