অপরাজেয় সুন্দরবন
বিস্ময়কর এক অরণ্য সুন্দরবন। বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এটি। জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘুর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফনী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবেলা করে সগৌরবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। যা দেশের অহঙ্কার।
তবে সেই সুন্দরবনে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া পানির বোতল ও খাবারের প্যাকেটসহ নানা প্লাস্টিক আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে বনের পরিবেশ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের স্থলজ ও জলজ প্রাণির জীবনচক্রে।
পাশাপাশি থেমে নেই বাঘ ও হরিণ শিকার। বনের খাদ্যচক্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখা প্রাণি দুটোকে হত্যা করছে চোরাশিকারিরা। বন বিভাগ বলছে, বনের ভেতরের পরিবেশ রক্ষার্থে পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে তারা কাজ করছে।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবচ্ছিন্ন জোয়ারধৌত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।
এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত, যার প্রায় ৬৯ শতাংশ স্থলভাগ ও ৩১ শতাংশ জলভাগ।
নামকরণ
সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানান মত। তবে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ হয়েছে ‘সুন্দরবন’। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে মিস্টার ডেভিড প্রেইন সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার গাছপালার ওপর লিখিত তার গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় এখানে।
৫০টির অধিক প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। এ বনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এ ছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণি। সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক।
সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ, এক থেকে দেড় লাখ চিত্রা হরিণ, ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বানর এবং ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার বন্য শূকর রয়েছে।
বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা
সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ৭৮৯তম বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। তিনটি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত এ বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার মোট আয়তন এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর।
প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এ বন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবন বায়ুম-লের কার্বন ধরে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমিত করে ও পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবন মাছ, জ্বালানি, মধু ও অন্যান্য অপ্রধান বনজদ্রব্যের উৎস। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে অতুলনীয় এবং ভ্রমণ পিপাসুদের প্রশান্তি ও আনন্দের উৎস।
ইকো-ট্যুরিজম
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের কারণে এখানে পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। প্রতি বছর বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক, ছাত্র-শিক্ষক সুন্দরবন ভ্রমণ করে। সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সাতটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট। গত অর্থ বছর (২০১৮-১৯) সুন্দরবনে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেছে। এরমধ্যে প্রায় দুই হাজার ৫০০ জন বিদেশি পর্যটক ছিলেন।
বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনে
২০১৯ সালে ক্যামেরা ট্র্যাকিং পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। এর আগের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে আটটি। তবে গত পাঁচ মাসে সুন্দরবন থেকে দুটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ।
তবে থেমে নেই হরিণ শিকার। প্রায়ই ফাঁদ পেতে চোরা শিকারিরা হরিণ শিকার করে থাকে। মাঝে-মধ্যে দু’একজন চোরা শিকারি ধরা পড়লেও অধিকাংশরাই ধরা পড়ে না।
জনবল সংকটে অরক্ষিত সুন্দরবন
জনবল সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ। খুলনা সার্কেলে এক হাজার ১৭৩টি মঞ্জুরিকৃত বিভিন্ন পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ১৯৪টি পদ।
সবচেয়ে বেশি শূন্য রয়েছে ডেপুটি রেঞ্জার, নৌকা চালক, বন প্রহরী, ফরেস্টার ও ইঞ্জিনম্যান পদে। গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচ পদে জনবল সংকট থাকায় অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন বিভাগ।
তবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বন অধিদপ্তর। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংরক্ষিত সুন্দরবনে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশসহ সকল কাজ ও বন হতে কাঠ আহরণ নিষিদ্ধ।
সুন্দরবনে ‘সুন্দরবন পূর্ব’, ‘সুন্দরবন দক্ষিণ’ ও ‘সুন্দরবন পশ্চিম’ নামে তিনটি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য এবং সুন্দরবনের গাঙ্গেয় শুশুক ও ডলফিনের আবাসস্থল রক্ষা ও বংশবৃদ্ধির জন্য আরও তিনটি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’কে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
মায়ের আঁচল সুন্দরবন
ঝড়-ঝঞ্জা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের আগ্রাসন থেকে বার বার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষ ও সম্পদকে মায়ের আঁচলের মতো রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত কাটতে না কাটতেই গত ১১ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে। এবারও উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বুক পেতে রক্ষা করেছে সুন্দরবন।
এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে এ জন্য সুন্দরবনকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
বন বিভাগের সূত্রমতে, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনে কোনো বন্যপ্রাণির প্রাণহানি না ঘটলেও অবকাঠামো ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তুলনায় অনেক কম। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বুলবুলের তা-বে পাঁচ হাজার ১৭৬টি গাছ উপড়ে ও ভেঙে গেছে। এরমধ্যে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগে চার হাজার ৫৮৯টি গাছ ও পূর্ব বন বিভাগে ৫৮৭টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মঈনুদ্দীন খান বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বন অধিদপ্তর তথা সরকারের পক্ষ থেকে সংরক্ষিত সুন্দরবনে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশসহ সকল কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে সুন্দরবনে প্রতিবছরই পর্যটক বাড়ছে। অনেক পর্যটক না বুঝে বনের মধ্যে প্লাস্টিক, কাগজপত্র ও বিভিন্ন রকমের খাবারের প্যাকেট ফেলে থাকেন। এতে বনের মধ্যে দূষণের সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে পর্যটকদের সচেতন করা হচ্ছে।