অটবি এখন অস্তিত্ব সংকটে

ফার্নিচার শিল্পে দশ বছর আগেও একক আধিপত্য ছিল বরেণ্য ভাস্কর নিতুন কুণ্ডের হাতে গড়া অটবির। ৩০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে দেশের বাইরেও অটবিকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হিসেবে চিনিয়েছেন তিনি।
তবে নিতুন কুণ্ডর মৃত্যুর পরই খেই হারিয়ে ফেলে এক সময়ের দেশের ফার্নিচার শিল্পের সেরা এ প্রতিষ্ঠানটি। মূল ব্যবসায় মনোযোগের পরিবর্তে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগসহ অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত মাত্র ১০ বছরে অটবিকে করেছে মৃত প্রায় কোম্পানি।
নিতুন কুণ্ডর মৃত্যুর পর ২০১৮ সালে অটবির বার্ষিক বিক্রি ছিল ২৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে এর ব্যবসা কেবল কমছে। পাশাপাশি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা। কারখানা ও শো-রুম নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। প্রধান কার্যালয় ও কারখানার জমি নিলামে তুলেছে বিভিন্ন ব্যাংক। দেনার দায়ে এখন বন্ধ হওয়ার পথে কোম্পানিটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অপরিকল্পিত বিনিয়োগ ডুবিয়েছে অটবিকে। পাশাপাশি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা অটবির পতনকে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন তারা।
অটবির অধপতন শুরু মূলত ২০১১ সাল থেকে। নিজেদের মূল ব্যবসা ফার্নিচার রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের কারণেই এ ধ্বস শুরু হয়। কোয়ান্টাম পাওয়ারে বিনিয়োগের শুরুতেই ২০০ কোটি টাকা জরিমানা গুণতে হয় কোম্পানিটিকে। নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদন শুরু করতে না পারায় এ জরিমানা করে সরকার।
জানা গেছে, ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ব্যবসায় নামে অটবি। কোয়ান্টাম পাওয়ার জেনারেশন নামে কোম্পানি গঠন করে ১০৫ মেগাওয়াটের দুটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে অটবি। চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৩ বছর মেয়াদী ভেড়ামারা কেন্দ্র নির্মাণে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি হয়। বিভিন্ন সমস্যার কারণে নির্ধারিত সময়ের ২১৮ দিন পর উৎপাদনে আসে কোম্পানিটি।
যশোরের নোয়াপাড়ায় ৫ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় প্রকল্পের জন্য চুক্তি করে ২০১০ সালের জুনে। নির্ধারিত সময়ের ৩১৬ দিন পর উৎপাদনে আসে এ প্রকল্পটি। এই দুই প্রকল্পে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জরিমানার মুখে পড়তে কোম্পানিটিকে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ জরিমানাই অটবিকে পিছিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অটবির একজন কর্মকর্তা বলেন, "বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন আসলেও জরিমানার কারণে মুনাফার পরিবর্তে উল্টো লোকসান গুণতে হয়েছে কোয়ান্টাম পাওয়ারকে। ফলে ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করা সম্ভব যায়নি।"
জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগের পর তা ফেরৎ না আসায় ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে অটবি। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ১০০ ঋণ খেলাপির সর্বশেষ তালিকায় কোয়ান্টামের পাশাপাশি উঠে এসেছে অটবির নামও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি হওয়া কোয়ান্টামের খেলাপি ঋণ ৮১৮ কোটি টাকা ও অটবির খেলাপি ঋণ ১১৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আদায়ে চলতি বছরের শুরুতে অটবির প্রধান কার্যালয় নিলামে তুলে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। আর শ্যামপুরের কারখানা নিলামে তুলে এবি ব্যাংক। যদিও কোম্পানি কর্তৃক হাইকোর্টে আবেদনের কারণে স্থগিত হয়ে আছে উভয় নিলাম প্রক্রিয়া।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভরাডুবির পাশাপাশি অটবির সংকট বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় আগুন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ আগুনে কোম্পানিটির সাভারের বিরুলিয়ার দুটি কারখানাই ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর একটি কারখানা এখনো চালু করতে পারেনি তারা। অপর কারখানাটিও চলছে কোনো রকমে।
১০ বছরের বেশি সময় ধরে অটবির সাভার কারখানায় চাকরি করা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে অপারেশনে থাকা কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের আগে নিয়মিত দুই হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতো। এখন তা এক হাজারের নিচে নেমে এসেছে।
আর্থিক সংকটের কারণে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে না পারায় অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাভার, মিরপুর ও শ্যামপুরে মোট চারটি কারখানা ছিল অটবির। বর্তমানে শুধু শ্যামপুর ও সাভারে দুটি কারখানা চালু রয়েছে। যদিও সাভার কারখানায় সক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন খুবই নগন্য। তাছাড়া যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় সক্ষমতাও অনেকাংশে কমে গেছে উভয় কারখানার।
অন্যদিকে দেনা ও চলতি মূলধনের কারণে কর্মকর্তাদের বেতন দিতে না পেরে বিক্ষোভের মুখে ২০১৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিটির মিরপুরের কারখানা। বর্তমানে ভাড়া হিসেবে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে ওই জায়গা।
সক্ষমতা ও উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রভাব দেখা গেছে বাজারেও। ফার্নিচারে বৈচিত্র না থাকায় বিক্রি কমে ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন শো-রুম এবং আউট লেটও । কোম্পানির কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি আউটলেট বন্ধ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আশঙ্কাজনক হারে কমেছে এর রাজস্ব প্রদাণের হারও।
রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ওই কমিশনারেটের অধীনে ৩টি কারখানা ও ৭টি শো রুম ছিল অটবির। ব্যবসা বন্ধ করার কারণে বর্তমানে একটি কারখানা ও তিনটি শো-রুম রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। চালু থাকা তিনটি থেকে রাজস্ব আহরণ অনেক কমেছে।
কমিশনার ড. মইনুল খান দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "কয়েক বছর ধরেই অটবি থেকে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স দেয়ার হার কমেছে। এর পেছনে কারখানা বন্ধ ও ব্যবসা কমে যাওয়াকে দায়ী করছে কোম্পানিটি।"
নাম প্রকাশ না করে অটবির কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন আসার আগেই জরিমানা দিতে গিয়ে পরিচালন মুলধন ঘাটতিতে পরে তারা। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় তা খেলাপী হয়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে ব্যবসা কমে যায় তাদের।
জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে অটবি লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। দেশ বরেণ্য ভাস্কর নিতুন কুণ্ড তিল তিল দেশের শীর্ষ ফার্নিচার কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অটবিকে। তার মেধা ও শ্রমের কারণে সারাদেশেই বিস্তৃত হয় অটবির ফার্নিচারের শপ। ঢাকায় গড়ে তুলেন চারটি বৃহৎ কারখানা। কিন্তু ২০০৬ সালে নিতুন কুণ্ডর মৃত্যুর পরই আসবাবের জগতে অনন্য এ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব সংকট দেখা দেয়। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও পোশাক খাতে বিনিয়োগের কারণে ক্রমেই জৌলুস হারায় অটবি।
(https://tbsnews.net/companies/otobi-once-top-now-death-throes-39049)