পরিচিত হই ‘আজকে আমার মন বালো নেই’র পেছনের কারিগরের সঙ্গে

গত কয়দিন ধরে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দুনিয়ায় যে লাইনটি বারবার অনুরণিত হচ্ছে তা বোধহয় এখন আর কারও শুনতে বাকি নেই। 'আজকে আমার মন বালো নেই'- এ শব্দগুচ্ছগুলোতে মন খারাপের কথা বলা হলেও তা বাঙালি নেটিজেনের মনে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ফোনকলে কাশেম চাচা নামক জনৈক চরিত্রকে চট্টগ্রামের ভাষায় আরেকজনের কাছে বারবার 'ভ্যালিডেশন' খুঁজতে শোনা যায় এ বাক্যটির মাধ্যমে।
তবে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা বাস্তব জীবনের আড়তদারের কাছ থেকে কোনো উপদেশই কানে নেন না কাশেম চাচা। পুরো সময়টা জুড়ে তাকে পান চিবোতে চিবোতে কথা বলতে শোনা যায়। কাশেম চাচা 'চাচা' হলেও তার কথা বলার ধরন সাত বছরের বাচ্চার মতো, আর সেটা শুনে যে কারোরই হাসি বাঁধ মানার কথা না।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। কাশেম চাচাকে নিয়ে আরও বিশ্লেষণ করার আগে আপনাদের জানিয়ে রাখি ওই ফোন কলে যিনি এত সব কাণ্ড করেছেন তিনি আসলে কোনো চাচা নন। বরং তার নাম কাজি হান্নান আহমেদ উৎস। বছর ২৬-এর এ যুবক 'কাশেম চাচা' সেজে এত সব কাণ্ডকারখানা করেছেন।
তবে বাস্তব জীবনেই কাশেম চাচার অস্তিত্ব রয়েছে। উৎস তাকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। কাশেম চাচার মুখে সবসময়ই একটা পান পোরা থাকে। সেকারণেই তার কণ্ঠস্বর শোনায় কিছুটা ভিন্ন। আর এ তাম্বুলরসে আচ্ছাদিত কণ্ঠেই মাত হয়েছেন নেটিজেনরা।

উৎস একজন মিমিক্রি শিল্পী। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এ শিল্পের চর্চা করে এসেছেন। তার মিমিক্রি শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছেন বন্ধুবান্ধবেরাও। তারপর একদিন তার মিমিক্রি শুনতে শুনতে বন্ধুরাই ঠিক করেন তারা ওটা রেকর্ড করে ইন্টারনেটে প্রচার করবেন।
উৎসদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। 'চিটাইংগে টিভি' নামের ওই চ্যানেলে উৎসের প্রথম মিমিক্রিটি প্রকাশ করার পর তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। ওই ফোনকল কনটেন্টে শোনা যায় উৎস কাশেম চাচা সেজে একজন দোকানদারকে বলছেন, তার কাছে প্রমাণ আছে দোকানদার বেআইনি পণ্য বিক্রি করেন।
ওই ভিডিও ইন্টারনেট জয় করে নিলে পরপর আরও কনটেন্ট তৈরি করেন তারা। তাদের সর্বশেষ একটি কনটেন্টে কাশেম চাচাকে তার পরিচিত ঢংয়ে একজন ইলেকট্রিশিয়ানের সাথে তামাশা করতে শোনা যায়।
'সে রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি আমার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা এক থেকে লাফ দিয়ে একেবারে দুই লাখে পৌঁছে গিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা লটারি জেতার মতো, আপনি কখনোই আগে থেকে বলতে পারবেন না কোন ভিডিওটি ভাইরাল হবে,' বলেন উৎস।
২০১৮ সালে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে চিটাইংগে টিভি শুরু করেন উৎস। কিন্তু চ্যানেলটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে। তাদের ভিডিওগুলোতে ব্যবহৃত ছবিতে দেখা যায় একটি ঠাণ্ডা মাথার শিবা ইনু (উৎস) আরেকটি ত্যক্তবিরক্ত শিবাকে (দোকানদার, ইলেকট্রিশিয়ান, পেইন্টার ইত্যাদি) ফোন করছে।'সে রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি আমার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা এক থেকে লাফ দিয়ে একেবারে দুই লাখে পৌঁছে গিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা লটারি জেতার মতো, আপনি কখনোই আগে থেকে বলতে পারবেন না কোন ভিডিওটি ভাইরাল হবে,' বলেন উৎস।
কাশেম চাচার প্রাঙ্ক কলে বিপর্যস্ত হন শিবা। শিবা ইনু তাকে যতই বিরক্ত করতে থাকে, ততই রাগে ফেটে পড়েন শিবা। আর এসব ছবির কারণে ভিডিওগুলো আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
তবে ভিডিওতে শিবা ইনু কুকুরগুলোর ছবির লেআউট তৈরি করেছেন জনৈক ভক্ত। তার আগে ভিডিওগুলো কেবল কল রেকর্ড বাজিয়েই তৈরি করা হতো। একজন ভক্ত একবার বিখ্যাত শিবা ইনুর ছবি ব্যবহার করে ওই কল রেকর্ডিং-এর ভিডিওটি আবার করলে উৎসদের তা ভালো লেগে যায়। এরপর থেকে নিজেদের সবগুলো ভিডিওতে ওই ফরম্যাট ব্যবহার করা শুরু করে চিটাইংগে টিভি।
ইকবাল, নিশু, ফাহাদ কিন ওয়াহিদ সাকিফ; এ তিনজন উৎসের বন্ধু। এদের সঙ্গে মিলেই কনটেন্ট নির্মাণ করেন উৎস। উৎস কাশেম চাচার ভূমিকায়, বাকি তিন বন্ধু কাশেম চাচার বিনোদনের খোরাক হতভাগ্যদের ভূমিকায় অভিনয় করেন। নিজেদের ফোনালাপগুলো তারা রেকর্ড করেন, এখন পর্যন্ত কখনো এগুলোর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেননি তারা।
কাশেম চাচার দুঃখ নিয়ে করা তাদের সর্বশেষ ভিডিওটি ইতোমধ্যে কেবল ইউটিউবেই ২৫ লাখবার দেখা হয়েছে। এর বাইরে ফেইসবুক ও অন্যান্য প্লাটফর্মে আরও লাখো ভিউ তো রয়েছেই। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, এই যে লাখ-লাখ মানুষ কাশেম চাচার দুঃখে 'দুঃখিত' হচ্ছেন, তাতে যেন বেচারার দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়।
উৎস আর তার বন্ধুরা বর্তমানে একটি ওয়েব সিরিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এর কাজটি যথাসময়ে তারা সারতে পারেননি। আর সে 'দুঃখ; থেকেই ভিডিওটি করার বুদ্ধি আসে তাদের মাথায়।
উৎস একজন পুরোদস্তুর কনটেন্ট নির্মাতা। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কয়েক মাস পড়ালেখা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পড়ায় তার মন বসেনি। তাই পড়ার বদলে কনটেন্ট তৈরি করতে শুরু করেন তিনি।
'পড়ালেখায় কখনো আকর্ষণ পাইনি। গতানুগতিক ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেও তা আমার জন্য হয়ে ওঠেনি। আমি কী করতে চাই সেটা নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বোধহয় শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী হয়ে পড়তাম, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেইসবুক পেইজ এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং আমি এ ফিল্ডেই কিছু একটা করতে চাই।'
'আমি টাকাপয়সা আয় করার জন্য এ চ্যানেলটি খুলিনি। বরং আমি মানুষকে বিনোদন দিতে চেয়েছিলাম। আর আমি বিশ্বাস করি, কনটেন্ট নির্মাণে সফলতার চাবিকাঠি হলো এটাই। আপনার দক্ষতা থাকলে, আপনি যদি মানুষকে প্রেরণা দিতে পারেন, যদি এটা করতে ভালোবাসেন- তাহলে নিজের জন্য, দর্শকদের জন্য করতে থাকুন। টাকা একসময় আসবেই।'
উৎসের কাজে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে তার মা-বাবার। 'আমি যখনই কোনো অডিও বা ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করি, আমার মা-বাবা সেটা সবার প্রথমে দেখেন। আমার মা প্রথমবার দেখার সময় আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মা হাসলেই কেবল সে কনটেন্ট আমি পোস্ট করি। আর না হাসলে আমি বুঝতে পারি কনটেন্ট তেমন মজাদার হয়নি এবং আমাকে সেটার ওপর আরও কাজ করতে হবে।'
অনেকে এখন উৎসকে নকল করে বাস্তবেই মানুষের সাথে প্রাঙ্ক করছে। উৎস স্রেফ একজন কনটেন্ট নির্মাতা এবং তার সব প্রাঙ্ক নিজের অভ্যন্তরীণ মানুষজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি চান সাধারণ মানুষও এটা বুঝুক। কেউ যদি কোনো কলে উৎসের কণ্ঠ শুনতে পান, তাহলে সেটা যে আদতে তিনি নন- এ কথাটি সবাইকে বুঝতে অনুরোধ করেছেন তিনি।