প্রাদুর্ভাবের যুগ: পশু থেকে আবারও মহামারির ব্যাপারে সতর্ক করলেন বিজ্ঞানীরা
কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্বজুড়ে নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে মাঙ্কিপক্স। গবেষকরা বলছেন, এখানেই শেষ নয়; পশুপাখি থেকে যেসব রোগ মানবদেহে বংশবিস্তার করতে পারে, তা হয়তো খুব দ্রুতই নতুন মহামারি সৃষ্টি করতে চলেছে।
জুনোসিসের মতো রোগগুলো পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান থাকলেও বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, বন উজাড়, ব্যাপকভাবে পশুচারণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাণী জগতের অন্যান্য মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এ ধরনের রোগবালাই মানুষের মধ্যে আরও সাধারণ হয়ে উঠেছে।
প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হতে পারে এমন অন্যান্য রোগের মধ্যে রয়েছে এইচআইভি, ইবোলা, জিকা, সার্স, এমইআরএস, বার্ড ফ্লু এবং বুবোনিক প্লেগ।
গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোভিডের উত্স সম্পর্কে এখনও তদন্ত চলছে। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, জুনোটিক সংক্রমণের সঙ্গে এর উৎপত্তির সংযোগ থাকতে পারে।
এরসঙ্গে গেল মাসে বিশ্বব্যাপী হাজারেরও বেশি মানুষের মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত হওয়ার খবরে ডব্লিউএইচও সতর্ক করেছে, এই রোগও কয়েক ডজন দেশে ছড়িয়ে পড়ার 'বাস্তব ঝুঁকি' রয়েছে।
ডব্লিউএইচও'র ইমার্জেন্সি ডিরেক্টর মাইকেল রায়ান গত সপ্তাহে বলেছিলেন, "কেবল মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেই নয়, মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে যেভাবে সংযোগ বাড়ছে, তা রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রে 'উদ্বেগজনক'।"
তিনি বলেন, "এই রোগগুলো মানুষের শরীরে যতবার প্রবেশ করছে, ততবারই এর সংখ্যা বাড়ছে, সেইসঙ্গে মানবদেহে রোগগুলোর প্রসারিত এবং স্থানান্তরিত হওয়ার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
মানুষের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত এই প্রথম নয়, ১৯৭০ সালে কঙ্গোতে সর্বপ্রথম মানবদেহে দেখা মিলেছিল এই রোগের। এরপর থেকে এটি মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজিস্ট অলিভিয়ার রেস্টিফ জানান, রোগটির নাম মাঙ্কিপক্স হলেও এর সঙ্গে বানরের কোনো সম্পর্ক নেই।
বার্তাসংস্থা এএফপি-কে তিনি আরও জানান, মাঙ্কিপক্স যদিও প্রথমে ম্যাকাক বানরের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু জুনোটিক সংক্রমণ প্রায়শই ইঁদুর থেকে হয় এবং এর প্রাদুর্ভাব মানুষের সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি কি আরও খারাপ হতে পারে?
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যানুসারে, মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয় এমন পরিচিত প্রায় ৬০ শতাংশ রোগই জুনোটিক, এরমধ্যে নতুন যেসব সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে এর ৭৫ শতাংশই এই ধারার।
রেস্টিফ বলেন, গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পশুচারণ বৃদ্ধি এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল দখলের কারণে জুনোটিক প্যাথোজেনের সংখ্যা এবং এর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
"মানুষের কার্যকলাপে (যেমন-বন উজাড়) বন্য প্রাণীরা নিজেদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে, তাদের আবাসস্থল উজাড় হওয়ায় অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে তারা," যোগ করেন তিনি।
এমনকি অপেক্ষাকৃত দুর্বল পশুপাখি, যারা মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখিদের সংস্পর্শে থাকতে পছন্দ করে, তাদের মাধ্যমেও নানান ধরনের রোগবালাই মানবদেহে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে বলে জানান রেস্টিফ।
ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ ফর ডেভেলপমেন্টের জুনোসিস বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন রোচের মতে, এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে বন উজাড়ের একটি বড় প্রভাব রয়েছে।
এএফপিকে তিনি বলেন, "বন উজাড় জীববৈচিত্র্যকে কমিয়ে দেয়। এর ফলে আমরা এমন প্রাণী হারিয়ে ফেলি, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।"
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বছরের শুরুতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দাবি করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন অন্যান্য মহামারির ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।
বন উজাড় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাণীরা তাদের উষ্ণ প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যত্র পালিয়ে গিয়ে তারা প্রথমবারের মতো অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে মিশছে। আর এভাবেই হয়তো হাজার হাজার বছর পুরনো জুনোটিক ভাইরাস তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে সংক্রামিত করছে। গবেষণা অনুযায়ী, গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই ভাইরাস 'নিঃশ্চুপভাবে সঞ্চালিত' হয়।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ডিজিস ইকোলজিস্ট গ্রেগ অ্যালবেরি বলেন, "হোস্ট-প্যাথোজেন নেটওয়ার্ক যথেষ্ট পরিবর্তিত হতে চলেছে।"
"এর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।"
"আমাদের শহুরে এবং বন্যপ্রাণী উভয় ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নজরদারি দরকার, যেন আমরা শনাক্ত করতে পারি কখন একটি রোগজীবাণু এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তরিত হয়। এবং যদি রোগ গ্রহণকারী প্রাণী শহুরে বা মানুষের কাছাকাছি থাকে এমন হয়, তবে আমাদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত," যোগ করেন তিনি।
ঝুঁকি প্রতিরোধের বিষয়ে রেস্টিফ বলেন, "এখানে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোনো চমকপ্রদ সমাধান নেই; ঝুঁকি কমাতে সব স্তরে কাজ করতে হবে আমাদের।"
"বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে, যেন বিলম্ব ছাড়াই প্রাদুর্ভাব শনাক্ত এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়," যোগ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ডব্লিউএইচও'র বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা দল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে নতুন জুনোটিক প্যাথোজেনের আবির্ভাবে কী করা উচিত, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি যুগে যুগে যেসব প্যাথজেনরা পশুপাখি থেকে মানুষের মধ্যে রোগজীবাণু ছড়িয়েছে তাদের একটি তালিকাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কীভাবে এরা মানবদেহে রোগ ছড়ালো, এর সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং পরিবেশগত প্রভাবের বিস্তারিত বর্ণনাও দেওয়া রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
- সূত্র: এএফপি