আম-দিওয়ানা: যেভাবে এক সম্প্রদায় বাংলায় এসে আমের স্বাদে মাতোয়ারা হলো
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে রাজস্থানের একদল সম্পদশালী ওসওয়াল জৈন সওদাগর প্রাচুর্যময় বাংলায় অভিবাসী হয়। উদ্দেশ্য, নতুন বাণিজ্য শুরু করা এবং থিতু হওয়া। তাদের সিংহভাগই মুর্শিদাবাদের অনতিদূরের যমজ শহর আজিমগঞ্জ ও জিয়াগঞ্জে বসতি স্থাপন করে। ওই সময় মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার নবাবের রাজধানী। পেশায় ব্যাংকার ও ফাইন্যান্সার এই অভিবাসীরা ঔপনিবেশিক ভারতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সম্প্রদায়গুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা পরিচিত হয় শেহেরওয়ালি (শহরবাসী) জৈন নামে।
শেহেরওয়ালিরা সানন্দে স্থানীয় জীবনধারাকে গ্রহণ করে। কোঁচা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরে শুরু করে তারা। মোচা ও কদবেলের উপাদানের গুণাগুণ আবিষ্কার করে। খাবারে পাঁচফোড়ন মশলারও ব্যবহার শুরু করে তারা। এবং মুর্শিদাবাদের অসাধারণ আমের মহাভক্ত হয়ে পড়ে। মিষ্টি মোলাজাম, দিলপসন্দ, চন্দন কাঠের সুগন্ধযুক্ত চন্দনকোষ, সুস্বাদু কোহিতুরসহ আরও অনেক আম তাদের মন জিতে নেয়।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদী আম হয়ে ওঠে সুরুচির আইকন। শেহেরওয়ালি জৈন ও মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সন্দীপ নওলাখা বলেন, শেহেরওয়ালিরা আমের চারাকে অন্যান্য সুগন্ধি ফল ও ফুলের সঙ্গে যুক্ত করার শিল্পকে আরও নিপুণ রূপ দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নতুন নতুন অনন্য জাত উদ্ভাবনে নেমে পড়ে। এই কাজের শুরুটা করেন আকবর। তারপর নবাবরাও এই প্রথা অব্যাহত রাখেন।
নবাবদের যুগ শেষ হওয়ার পরও আজিমগঞ্জ ও জিয়াগঞ্জের বাগানগুলো ওই অঞ্চলের সেরা আম উৎপাদন করে গেছে। নিজেদের বাগানের আমি নিয়ে দারুণ গর্ব করত শেহেরওয়ালিরা। শেহেরওয়ালিরা তাদের হাভেলিতে মূল্যবান জাত প্রদর্শনের জন্য মহা সমারোহে আমের ভোজসভার আয়োজন করত।
বিশেষ করে জিয়াগঞ্জে শ্রীপত সিং দুগারের বার্ষিক আম উৎসব কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। 'দি নিউ ইন্ডিয়া, ১৯৪৮-১৯৫৫: মেমোয়ার্স অভ অ্যান সিভিল সার্ভেন্ট' বইয়ে অশোক মিত্র লিখেছেন, 'শ্রীপত সিং দুগার বছরে একবার তার বাড়িতে আম পার্টি দিতেন। সেখানে পঞ্চাশ থেকে ষাট জাতের আম পরিবেশন করা হতো।'
আজিমগঞ্জের পৈতৃক বাংলোতে প্রতিদিনের আমের ভোজের স্মৃতি রোমন্থন করেন নওলাখার। 'প্রতিদিন বিকেলে, ৪টার দিকে, পরিবারের সব বাচ্চাদের বাইরের উঠোনে ডেকে পাঠানো হত। সেখানে গিয়ে দেখতাম আমাদের মা, দাদি, খালারা গোল হয়ে বসে আমের খোসা ছাড়াচ্ছেন, তারপর কাটছেন। আমরা মেঝেতে বসে গা থেকে শার্ট খুলে ফেলি, যাতে ওগুলোতে আঠালো আমের রসের দাগ না লাগে। তারপর যতক্ষণ কুলায়, ততক্ষণ আম খেতাম।'
শেহেরওয়ালি জৈনরা মৌসুমের সেরা আমগুলো পাঠিয়ে দিত রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। বাকিংহ্যাম প্যালেস থেকে প্রাপ্তিস্বীকারের চিঠি পাঠাতেন রানি। সেসব চিঠি সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন শেহেরওয়ালি জৈন বিক্রম দুগার।
আম নিয়ে এরকম অসংখ্য মধুর স্মৃতি রয়েছে সম্প্রদায়টির। আম নিয়ে তাদের পরীক্ষানিরীক্ষা, মাতামাতির অন্ত ছিল না।
সিদ্ধার্থ দুধোরিয়া জানান, 'এমনও অনেকে ছিল যারা নির্দিষ্ট জাতের আম রাতের বেলায় সাবধানে বিছানার নিচে রেখে দিত। রাতে বেশ কয়েকবার জেগে সেগুলো ওগুলো জায়গামতো আছে কি না পরখ করে দেখত।'
আম ঠিকমতো পাকার পর গোটা পরিবারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হতো। কর্মচারীদের ডেকে আনা হতো। তারপর আম ধোয়ার জন্য বের করা হতো বড় বড় পিতলের পাত্র। দারুণ পরিশ্রম করে ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে, কেটেকুটে মহানন্দে খাওয়া হতো। কখনও গভীর রাত, কখনও ভোরের প্রথম প্রহরে এই আমযজ্ঞ চলত।
জীবনের প্রতিচ্ছবি
কেউ কেউ এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এটা সত্য যে, আম নিয়ে একজন প্রকৃত শেহেরওয়ালির আবেগ সীমাহীন। একজন শেহেরওয়ালি আমকে রীতিমতো সন্তানের মতো আদর করেন। একটি আম সঠিক মাত্রায় পাকতে কতদিন লাগবে এবং ঠিক কখন ফলটি খেলে সবচেয়ে ভালো স্বাদ পাওয়া যাবে, তা বোঝার এক অদ্ভুত দক্ষতা আছে তার। আর একজন শেহেরওয়ালি জৈন প্রায় বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতায় এবং নান্দনিকভাবে আম কাটতে পারেন।
আরেক গর্বিত শেহেরওয়ালি দেবাশিস কুঠারি বলেন, 'আম কাটার শেহেরওয়ালি-স্টাইল অতুলনীয়। স্রেফ সঠিকভাবে কাটা না হয় না বলে আমরা বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে আম খাই না।'
শেহেরওয়ালি মহিলারা আম কাটার মামুলি কাজটিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিশীলিত শিল্পে পরিণত করেছেন বলে জানান নওলাখা। আমের খোসা ছাড়ানো এবং আম কাটার জন্য শেহেরওয়ালিরা বিশেষ ছুরি তৈরি করেন। এই ছুরিগুলো প্রথমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে ঠান্ডা করা হয়।
দুধোরিয়া জানান, 'প্রথমদিকে বেশি সুস্বাদু জাতের আমগুলো পাতলা, ধারালো বাঁশের কীলক দিয়ে কাটা হতো।'
প্রথমে নিপুণ হাতে, আলতো করে, সযত্নের খোসা ছাড়ানো হয়—যাতে ফলের শাঁসে ব্লেডের ছাপ না পড়ে। তারপর আমটিকে সাবধানে এক হাতের তালুতে রেখে, আঁটিতে ছুরির ছোঁয়া না লাগিয়ে ফলের শাঁসে ক্রুশের মতো দুটি ছেদ করা হয়। সবশেষে ছুরির আরেক পোঁচে আমটিকে সমান আকারের চার টুকরায় কাটা হয়।
আমের মৌসুমে শেহেরওয়ালি পরিবারের প্রতি বেলার খাবারে তাজা আম থাকবেই। দুগার বলেন, 'আমরা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, চা ও রাতের খাবারে আম খাই।'
তারপর আছে গ্লাসভর্তি আম পান্না ও আম রস। সন্দীপ নওলাখা জানালেন, শেহেরওয়ালি-স্টাইলের আম রাস সাধারণ রসের চেয়ে আলাদা। শেহেরওয়ালি আম রসের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।
আমের যত পদ
নওলাখা পরিবারের বিখ্যাত রেসিপি হলো সম্পূর্ণ পাকা আম দিয়ে তৈরি (অবশ্যই খোসাসহ) একটি সুস্বাদু তরকারি, যা জাফরান ও সুগন্ধি মশলা সহযোগে প্রচুর পরিমাণে ঘি দিয়ে রান্না করা হয়। তরকারিটি সাধারণত সাদা ভাত বা গরম চাপাতির সঙ্গে খাওয়া হয়।
সাধারণ বাঙালি পাঁচফোড়ন দিয়ে ঘি সহযোগে রান্না করা কাঁচা আমের মণ্ড দিয়ে বানানো একটি তরকারির কথা জানালেন আরেকজন শেহেরওয়ালি জৈন।
দেবাশিস কুঠারি বলেন, 'গ্রীষ্মকালে আরেকটি প্রিয় খাবার হলো আম কা মাদিয়া। পাকা আম আর মশলা দিয়ে তৈরি একটা পাতলা, সুগন্ধযুক্ত স্যুপ। এটি সাধারণত খিচুড়ির সাথে পরিবেশন করা হয়।'
এছাড়াও আছে নানা জাতের আম দিয়ে তৈরি আচার ও চাটনি, আমের পেদা (নরম মিঠাই) ও ঘরে তৈরি আমের পাপড়।
গাঁজানো আমের আচারের পাশাপাশি শেহেরওয়ালিরা নিপুণভাবে কাটা কাঁচা আম দিয়ে একটি তাজা আচার বানায়।
তবে শেহেরওয়ালিদের ভান্ডারের সবচেয়ে মূল্যবান রেসিপিগুলোর একটি হলো কাচ্চে আম কা ক্ষীর। সর পড়া দুধ ও কুচি কুচি করে কাটা কাঁচা আম দিয়ে তৈরি ক্ষীর (টক স্বাদ দূর করার ধুয়ে সেদ্ধ করা হয়) দারুণ সুস্বাদু খাবার। এই খাবারে আরও দেওয়া হয় জাফরান ও গোলাপ জলের ছিটা। এই ক্ষীর ঠান্ডা করে বরফের ওপর রেখে পরিবেশন করা হয়।
অনেক শেহেরওয়ালি পরিবার এখন কলকাতায় বসতি স্থাপন করেছে। মে মাস শেষ হলেই কলকাতার শেহেরওয়ালি পরিবারগুলোতে মুর্শিদাবাদের আশপাশের বাগান থেকে আমের কার্টন চলে আসে।
দুগার জানালেন, কিছু বাড়িতে আম রাখার জন্য পুরো একটা ঘর খালি করে দেওয়া হয়। আসবাবপত্র সরিয়ে মেঝে সাফ করা হয়। আমগুলোর ওপর প্রায়ই নিজ নিজ জাতের নাম লেখা থাকে।
দুঃখের বিষয় হলো, মুর্শিদাবাদী আমের শত শত অনন্য জাতের খুব অল্প সংখ্যকই এখন বড় আকারে চাষ করা হয়। কিছু কিছু জাত তো বিলুপ্তির পথে।
তবে প্রতি বছর জুন মাসে মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি কলকাতার আইটিসি সোনার-এর সহযোগিতায় জেলার শেহেরওয়ালি বাগানে হওয়া মুর্শিদাবাদী আম প্রদর্শন ও প্রচার করার জন্য আম হাটের আয়োজন করে। এই হাটে বোনাস হিসেবে থাকে শেহেরওয়ালি সংস্কৃতি ও রন্ধনপ্রণালীর ঝলক।
- স্ক্রল ডট ইন থেকে অনূদিত