দুলালের তালমিছরি যেভাবে বিখ্যাত ও বাঙালি জীবনের অংশ হয়ে গেল

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উকি মারে আকাশে।
সাধারণ মিছরি তৈরি হয় চিনি দিয়ে। অন্যদিকে তালমিছরি বানানো হয় তালগাছের রস থেকে। বাংলাদেশে তালগাছ অতি সাধারণ একটি গাছ। রবিঠাকুরের এই ছড়াটির মতোই এ দেশের রাস্তাঘাটে হুটহাট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা তালগাছের দেখা মেলে। তালের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে এরপর তা ক্রিস্টালে পরিণত করার মাধ্যমে তালমিছরি পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে তালমিছরির কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুলালের তালমিছরির কথা।
তালমিছরির অনেক গুণ। বাচ্চারা অসুখে পড়লে দুধের সাথে তালমিছরি মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। বাঙালির ঘরে তালমিছরি একটা সময় খুব স্বাভাবিক একটি উপাদান ছিল। যদিও এখন দিন বদলেছে, আধুনিক বাঙালির মনে ও মুখে পুরনো জিনিস আর তেমন একটা রোচে না। তবুও সমঝদার বাঙালির কাছে দুলালের তালমিছরি এখনো সমান প্রিয়।
নব্বইয়ের দশকে কলকাতায়া যারা বেড়ে উঠেছে, তারা সবাই বাড়িতে দুলালের তালমিছরির বোতল দেখেই বড় হয়েছে। বাংলাদেশের বাঙালি, যাদের বাড়িতে তালমিছরির চল ছিল, তারাও দুলালের তালমিছরিতেই ভরসা পেতেন। বাঙালির ঘরে ঘরে তখন তালমিছরির সঙ্গে আরও শোভা পেত ইসবগুলের বোতলও।
গ্রীষ্মে কয়েকদিন পরপরই মৌরি-মিছরির জল খাওয়া হতো। সকালবেলা ওই ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা জল খেয়ে দিনের শুরু হতো আমাদের। একমুঠো মৌরিদানা আর কয়েক চাক ঘোলাটে-হলুদ দুলালের তালমিছরি জগের মধ্যে ফেলে সারা রাত রাখা হতো। এরপর সকালবেলা বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে গ্লাসে করে সে শরবত ভাগ করে দেওয়া হতো।

আমার কাছে বেশি ভালো লাগতো কেবল মিছরির জল। গরমের দিনে স্কুল থেকে ফিরে খেতাম সেটা। তবে বাড়ির বড়দের চোখের আড়ালে কৌটা থেকে তালমিছরি চুরি করে খাওয়ার আনন্দ আলাদা ছিল।
আমার মতো এরকম অনেকেরই দুলালের তালমিছরি নিয়ে স্মৃতি মিলে যাবে বোধহয়। দিল্লির বাসিন্দা তনুশ্রী ভৌমিকের অভিজ্ঞতার কথাই বলা যাক। ১৯৮০-এর দশকে আসামে বেড়ে ওঠেন তিনি। বাড়িতে সবসময় দুলালে তালমিছরির একটা কৌটা থাকত। 'গ্রীষ্মকালে মিছরির জল আর লেবু মিশিয়ে খেতাম আমরা,' স্মৃতিচারণ করেন তিনি। ভৌমিক জানান এটা একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। আজকাল দিল্লির তীব্র গরমে মাঝেমধ্যে তালমিছরির জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটান তিনি।
'কাশি আর সর্দি সারাতে দারুণ উপকারী এই তালমিছরি,' আরেকবার এ অমোঘ সত্য মনে করিয়ে দিলেন ফুড ব্লগার সায়ন্তনী মহাপাত্র। আসলে দুলালের তালমিছরি প্রথমদিকে বিক্রি হতো কফ-শ্লেষ্মার পথ্য হিসেবে। বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো: সর্দি ও কাশিতে দুলালের তালমিছরি। অনেকেই তালমিছরিকে পথ্য হিসেবে বিশেষভাবে মান্য করতেন। আমার ঠাকুরমাও ওই দলে ছিলেন। যখনই বাড়িতে কারও সর্দি-কাশি হতো, ঠাকুরমা তুলসি, বাসক পাতা দিয়ে তালমিছরি জাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।'
ঢাকার কাছে শিবপুরে ছিল সাংবাদিক ফয়সাল মাহমুদের দাদার বাড়ি। ছোটবেলায় সেখানে বেড়াতে গেলে দুলালের তালমিছরি খাওয়ার কথা এখনো মনে করতে পারেন তিনি। 'দাদা তালমিছরি দিয়ে আমাদের জন্য তার ভালোবাসা প্রকাশ করতেন,' বলেন মাহমুদ, 'তিনি দুলালের তালমিছরির এত বড় ভক্ত ছিলেন যে ১৯৯০-এর দশকে ঢাকার নিউ মার্কেট থেকে সরাসরি তালমিছরি আনাতেন তিনি।'
কিন্তু কীভাবে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো দুলালের তালমিছরি? কীভাবে প্রায় আট দশক ধরে মিছরির বাজারে একছত্র আধিপত্য ছিল দুলালের? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে দুলালের জন্মের সময়ে।
ব্র্যান্ড-এর উত্থান
১৯৩০-এর দশকে দুলাল তার তালমিছরির ব্যবসায় শুরু করেন। তবে তারও আগে থেকেই এখানে তালমিছরি পাওয়া যেত। বাংলাদেশে তালগাছ অতি-সাধারণ একটি গাছ। সুভাষ মজুমদার তার বাণিজ্যে বাঙালি সেকাল ও একাল বইয়ে লিখেছেন, হুগলিতে অনেক আগে থেকেই তালের রস থেকে চিনি তৈরি করা হতো। সেসবের মধ্যে ছিল তালের গুড় ও মিছরিও। এছাড়া সিলন, মাদ্রাজ ও অন্যান্য জায়গা থেকেও প্রচুর পরিমাণে তালমিছরি কলকাতাতে আনা হতো।
দুলাল চন্দ্র ভড় যখন তার ব্যবসায় শুরু করেছিলেন, ভারতে তখন স্বদেশী আন্দোলনের জ্বর চলছে। তার জেরে বাংলাদেশেও স্থানীয়ভাবে জিনিসপত্র তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। হুগলির রাজবলহাট গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার ছিলেন ভড়েরা। কাপড়ের ব্যবসায় থেকে ভালোই আয় হতো তাদের। এর পেছনে বড় কৃতিত্ব ছিল জহরলাল ভড়ের।
সুধীর কুমার মিত্র-এর হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ বইয়ে জহরলাল ভড়ের নানা সমাজসেবার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই বইয়ের তথ্যমতে, এ জহরলালই প্রথমবারের মতো মিছরির ব্যবসায় শুরু করেন। তিনি ব্যবসায় শুরু করেছিলে ছেলে দুলাল চন্দ্র ভড়ের নামে।
কলকাতা থেকে ভিডিও কলে কথা হলো দুলাল ভড়ের মেজো ছেলে ধনঞ্জয় ভড়ের সাথে। 'প্রথমে সাদা মিছরির ব্যবসায় শুরু করেছিল আমাদের পরিবার। তখন এ মিছরির চাহিদা ছিল অনেক,' নিজেদের পারিবারিক ব্যবসার ইতিহাস জানা গেল তার কাছ থেকে।
তিনিই জানালেন, তার বাবা দুলাল চন্দ্রই প্রথম চিনির মিছরির বদলে তাল মিছরির ব্যবসায় শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তার বাবার চেষ্টাতেই ব্রিটিশ প্রশাসন থেকে দুলালের তালমিছরির ট্রেডমার্ক লাভ করে। এরপর থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ব্র্যান্ডটি। 'যদিও ৩৯৬৫ ট্রেডমার্ক নাম্বারটি এখন আর কোনো কাজের নয়, তবুও অতীতের কথা স্মরণে রেখে আমরা এখনো নাম্বারটি লেবেলের ওপরে ছাপাই,' বলেন ধনঞ্জয় ভড়।
তালমিছরি বানানোর প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানান ধনঞ্জয়। মার্চের শেষ ও জুনের শুরুতে তালের রস সংগ্রহ করেন কারিগরেরা। এরপর সেগুলোর গাঁজন রোধ করার জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপর সেই রসকে কলিচুনের দাগকাটা মাটির পাত্রে সংগ্রহ করা হয়। এ সংরক্ষিত তালের রস দিয়েই বছরজুড়ে মিছরি বানানো হয়।
মিছরি বানানোর জন্য তালের রসকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় আঁচ দিয়ে ঘনীভূত করা হয় বা তালের ঝোলাগুড় তৈরি করা হয়। এরপর সেটাকে ট্রেতে বসিয়ে নয় দিন রেখে দেওয়া হয়। ঠিক নয় দিন পর ট্রে-এর ওপরে ও নিছে ঝোলাগুড় ক্রিস্টাল মিছরিতে পরিণত হয়। মাঝখানে তরল অবশিষ্টাংশ রয়ে যায়। ওই তরল সাবধানে ফেলে দিয়ে মিছরি কাটা হয়। এরপর সেই কাটা মিছিরিকে রোদে শুকিয়ে প্যাকেজ করা হয়। ধনঞ্জয়ের তথ্যমতে, এভাবে মিছরি তৈরি করার জন্য দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন হয়। নয়-দশ লিটার তালের রস থেকে এক কেজির মতো মিছরি পাওয়া যায়।
দুলালের তালমিছরির এত সাফল্যের পেছনের রহস্য কী? ধনঞ্জয় মনে করেন ভালো মানের উপাদান দিয়ে এ মিছরি তৈরি করা হয় বলে দশকের পর দশক বাঙালির কাছে সমাদৃত হয়েছে এটি। তবে এর পেছনে আরও কারণ আছে। শুরু থেকেই দুলালের তালমিছরিকে বাজারজাত করা হয়েছে সর্দি-কাশি, কফের কার্যকরী পথ্য হিসেবে। আগের সব বিজ্ঞাপনেই ভেজাল তালমিছরির ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হতো। বাঙালির মনে এভাবেই জায়গা করে নিয়েছে এটি। তাদের কাছে অজানা বিদেশি জিনিসের চেয়ে ঘরের পাশে বানানো দুলালের তালমিছরি বেশি আপন মনে হয়েছিল। এছাড়া ভড়েরা ছিলেন প্রভাবশালী, তাদের টাকা-পয়সার জোরও ছিল। এটিও দুলালের তালমিছরিকে বাংলায় ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

মিছরি নিয়ে তেতো দ্বন্দ্ব
জানা যায়, ১৯৮৫ সালে দুই ভাই দুলাল চন্দ্র ভড় ও সনাতন ভড় ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাদের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। দু'ভাইকে পরে ব্র্যান্ডের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আপসরফায় যেতে হয়, তবে দুই ভাই তাদের ব্যবসায় নিয়ে আলাদা হয়ে যান।
'শুরু থেকেই দুলালের তালমিছরির প্রস্তুতকারক হিসেবে দুলাল চন্দ্র ভড়ের নাম লেখা থাকত লেবেলের গায়ে। দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের পর ঠিক হয়, সনাতন ভড় তার ব্যবসায়র জন্য 'দুলালের তালমিছরি' নামটি ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু প্রস্তুতকারক হিসেবে দুলাল চন্দ্রের নাম রাখতে পারবেন না,' জানান ধনঞ্জয়, 'অন্যদিকে আমার বাবা মিছরিকে 'দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি' হিসেবে নতুন নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন। একই সাথে তিনি লেবেলে তার ছবি আর স্বাক্ষরও জুড়ে দেন।'
এরপর থেকে বাজারে 'দুলালের তালমিছরি' ও 'দুলাল চন্দ্র ভাড়ের তালমিছরি' দুটোই সমানে ব্যবসায় করে এসেছে। এখনো দুলালের তালমিছরির বেশ চাহিদা রয়েছে গড়পড়তা বাঙালির কাছে। পশ্চিমবঙ্গের একটি ই-কমার্স প্লাটফর্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা তন্ময় সর জানান, তার প্লাটফর্ম থেকে মাসে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ বোতল তালমিছরি বিক্রি করা হয়। এছাড়া সম্প্রতি বাংলার বাইরে থেকেও খরিদাদেশ পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
ব্র্যান্ডের নাম যা-ই হোক না কেন, বাঙালির মনে চিরঅম্লান হয়ে থাকবেন দুলাল চন্দ্র ভড়। এ যুগের ছেলেমেয়েরা হয়তো একটুকরো তালমিছরি চুরি করে খাওয়ার আনন্দ কখনো অনুভব করতে পারবে না, তবুও বাঙালির পারিবারিক জীবনের এখনো এক অবিচ্ছেদ্য অংশ দুলালের তালমিছরি।
সূত্র: স্ক্রল ডট ইন
মূল লেখা: প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি
সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত