দীর্ঘদিনের অভ্যাস কাটিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে ভারসাম্য আনবেন কীভাবে?
দিনকে দিন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। করোনা মহামারির সময় এই মাত্রা আরও ভয়ংকর রূপে দেখা দেয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, মহামারির সময় বন্দি জীবনের সঙ্গী হিসেবে তরুণ-তরুণীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছিল। অত্যাধিক মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ফলে এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি ঝোঁককে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় মহামারি হিসেবে দেখছেন।
সম্প্রতি বিখ্যাত স্প্যানিশ অভিনেত্রী 'পেনেলোপ ক্রুজ' গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি তার কোন সন্তানকে ১৬ বছরের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে দিবেন না।
গবেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সূক্ষ্মভাবে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য থেকে ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ছে এবং এর ফলে তাদের জীবনে নানা পরিবর্তন ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে- কিন্তু কীভাবে!
'আমেরিকান একাডেমি অব চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রির' তথ্যানুসারে ১৩-১৭ বছর বয়সী আমেরিকার ৯০ ভাগ কিশোর-কিশোরী সক্রিয়ভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। আমেরিকার অনলাইন পরিসংখ্যান পোর্টাল 'স্ট্যাটিস্টা'-এর ২০২০ সালের তথ্য বলছে, দেশটির ৬৩ শতাংশ বাবা-মা তাদের সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অত্যধিক মাত্রায় ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছিল, মহামারি শুরুর পর থেকেই তাদের সন্তানদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা আরও ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
'মেন্টাল হেলথ আমেরিকার' তথ্য বলছে, মহামারির আগ পর্যন্ত তরুণদের মধ্যে যারা হতাশায় ভুগছিলো তাদের সংখ্যা ২০২১ সালে বেড়ে ২ লক্ষ ৬ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য বলছে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সালে মার্কিন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যা ৩১ শতাংশ বেশি ছিল। ২০২১ সালে ২০১৯ সালের তুলনায়, আত্মহত্যার চেষ্টা করে চিকিৎসা নিতে আসা ৫১ শতাংশই ছিল ১২-১৭ বছর বয়সী কিশোরী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক দিক
মহামারির সময় মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার ফলে এগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক ভাবে ছাপ ফেলে দিয়েছে। শুধু কি তাই? না, এমনকি পূর্বের করা গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু করোনাকালীন সময়তে নয় তার বহু আগের থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২০১৫ সালে ইউরোপের শিশুদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুরা দৈনিক ৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতো তাদের মানসিক সমস্যার মাত্রা অন্যদের তুলনায় বেশি ছিল। দৈনন্দিন যে যতো বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, তার মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ততোটাই বাড়তে থাকে।
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আরও যে যে ক্ষতিকর দিকগুলো রয়েছে -
- কোথায় কী ঘটছে বা অন্যরা কি করছে তা জানতে না পারলে, অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করা।
- কোনো ঘটনা বা বীভৎস কোন ভিডিও দেখা, যা ব্যক্তিকে ট্রমায় ফেলে দিতে পারে।
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা বা ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়া।
- সাইবার বুলিং-এর শিকার হওয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যদের জীবন-যাত্রা, তাদের সফলতার গল্প অনেকের মধ্যে নিজেদের কে নিয়ে হতাশার জন্ম দেয় যা মানসিক শান্তি ধ্বংসের একটি মূল কারণ। কিশোর-কিশোরীরা তাই নিজেদের কে অন্যদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে লেগে পরে। এসব করতে গিয়ে তাদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠে সে কোন পোশাক পরলে তাকে আকর্ষণীয় লাগবে, কীভাবে ছবি তুলবে এবং তখন তাকে দেখতে কেমন লাগবে এই বিষয়গুলো। এসব মিথ্যা চিন্তা একসময় তাদেরকে অসুখী করে তুলে।
বাস্তব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জগতের ভারসাম্য তৈরি
দুই বছর ঘরবন্দি জীবনের বেশিরভাগ সময় ভার্চুয়াল জগতে কাটানোর পরে, এটা থেকে বেড়িয়ে আসা অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার বলা চলে। বেশিরভাগ তরুণদের জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অবিচ্ছেদ্য জায়গা করে নিয়েছে। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা থেকে বিশ্বের খবরাখবর দ্রুত পেতে এটার ওপর মানুষের দিনকে দিন নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। তাই এটা বাদ দিয়ে অনেকেই নিজেদের জীবন কল্পনা করতে পারেন না। তাই এর ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে না দিতে বলে, দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে এটার সাথে ভারসাম্য রেখে অন্য কাজ করা যায় তার পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকে শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানাতে হবে এবং পরিবারের সাথে বেশি করে সময় কাটাতে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। শিশুদের কে ছোটবেলা থেকে সামাজিক বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে। এগুলো তাদের মানসিক বিকাশ ঘটিয়ে তাদেরকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার কমাতে করণীয়
- অবসর ও অন্যান্য সময়ে নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে রাখতে হবে। ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমাতে যাওয়ার আগে মোবাইলে স্ক্রল করার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
- বাড়ির মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট জায়গা নির্বাচন করে রাখা, যেখানে মোবাইল ছাড়া সময় কাটানো যাবে। সেটা হতে পারে বাড়ির ছাদ, রিডিং রুম বা বারান্দার মতো জায়গা।
- কী পরিমাণ সময় আপনি ও আপনার পরিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছেন তা দেখতে 'social fever' বা 'stay free' অ্যাপ মোবাইলে চালু করে নিতে পারেন। তারপর পরিবারের যে সদস্য সবচেয়ে কম সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেছে তাকে পুরস্কৃত করতে পারেন, এটা দেখে অন্য সদস্যরাও উদ্বুদ্ধ হবে।
- কর্মক্ষেত্রে যেমন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়া যায়, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সাময়িক ছুটি নিয়ে পরিবারের কাটানো ও অন্য কাজে সময় ব্যয় করা।
- সূত্র: হেলথলাইন