'ডু নাথিং গাই': কিছু না করে টাকা কামাচ্ছেন জাপানের যে ব্যক্তি!
নতুন চাকরিতে যোগদানের উদ্দেশ্যে টোকিও ছেড়ে যাওয়ার আগে আকারি শিরাই চেয়েছিলেন শহরে নিজের প্রিয় রেস্টুরেন্টটিতে শেষবারের মতো দুপুরের খাবার খেতে। কিন্তু পকেটে টাকা থাকলেও তার সাথে ছিল না কোনো সঙ্গী। একা একা খেতে বসে সদ্য ডিভোর্স দেওয়া স্বামীর কথা ভেবে বিরক্ত হতে চাননি আকারি। আবার বন্ধুবান্ধব ডেকে খুব হইহল্লা করার ইচ্ছাও ছিল না তার। তাই তিনি জাপানের একজন 'ডু-নাথিং গাই' বা অপরিচিত আগন্তুককে ভাড়া করলেন!
সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ ভাড়া করে পাশে বসিয়ে খাওয়া, খুব অদ্ভুত ঠেকছে না? কিন্তু জনৈকা জাপানি নারীর জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ সমাধান! ৪৫ মিনিটের সেই খাওয়ার সময়টায় আকারি এবং আগন্তুকের কথপোকথনকে নৈঃশব্দ বললেও ভুল হবে না। খেতে খেতে আকারি শিরাই আগন্তুককে তার প্রাক্তন স্বামীর ছবি দেখালেন, কিছু পুরনো স্মৃতিচারণ করলেন। আগন্তুক তাকে 'হু-হ্যাঁ' এর মতো কিছু সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো বা সামান্য হাসলো। কিন্তু তিনি নিজ থেকে কোনো কথা বাড়ালো না। আর আকারি শিরাই ঠিক এটাই চেয়েছিলেন!
২৭ বছর বয়সী নারী আকারি বলেন, "আমার মনে হচ্ছিলো আমি একজন মানুষের সাথে আছি, আবার মনে হচ্ছিলো কেউই নেই। কারণ সে এমনভাবে ছিল পুরো সময়টা যে তার দিকে আমার কোনো মনোযোগ দিতে হয়নি বা তাকে নিয়ে ভাবতে হয়নি। কথা বলার কোনো চাপও অনুভব করিনি আমি। এবারই প্রথম আমি প্রায় নিঃশব্দে খাওয়াদাওয়া শেষ করেছি।"
বেশ কয়েকবছর ধরেই জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় গড়ে উঠেছে 'আগন্তুক ভাড়া করা'র এই সংস্কৃতি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেখানে সঙ্গীসহ যাওয়ার রেওয়াজ, সেখানে নিজের ইমেজ বজায় রাখার উপায় হিসেবে এসব আগন্তুককে বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা অন্য পরিচয়ের ছদ্মবেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু গত চার বছর যাবত জাপানের শোজি মোরিমোতো (৩৮) আগন্তুক হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। জাপানি সমাজের প্রথাগত রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে এসে গ্রাহককে মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলতে তাকে সঙ্গ দিয়ে সাহায্য করেন শোজি। শোজি মোরিমোতোর ডাকনাম 'রেন্টাল-সান'। তার কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে একটি টিভি সিরিজ এবং তিনটি বই। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল পোস্টের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়ও সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি।
সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমে 'ছদ্মবেশী সঙ্গী' নামক পরিচিতিকে ছাপিয়ে গেছেন শোজি। তার কাজের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। ম্যারাথন দৌড়ে এসে শেষ প্রান্তে পরিচিত মুখ দেখতে চেয়েছেন বলে কেউ ভাড়া করেছেন তাকে, কেউবা গবেষণাপত্র শেষ করার সময় একাকীত্ব দূর করতে পাশে বসিয়ে রেখেছেন। মহামারিকালে মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে কতটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন মানসিকভাবে, সেসবও তার কাছে শেয়ার করেছেন অনেক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী।
প্রতি সেশনে ১০,০০০ ইয়েন (৮৫ ডলার) ফি নেন শোজি। ফি খানিকটা বেশি হওয়া সত্ত্বেও পীড়িত-একাকী মানুষেরা প্রায়ই তাকে ভাড়া করেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে যেসব মানসিক যন্ত্রণার কথা শেয়ার করতে তারা দ্বিধা বোধ করেন, সেগুলো শোজির কাছে শেয়ার করেন তারা। শোজির কাজ হচ্ছে শুধুই গ্রাহকের কথা শুনে যাওয়া; তিনি কখনো কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ভালোমন্দ বিচার করতে যান না।
বিচ্ছেদের আবেদন নিয়ে যাওয়া জনৈকা নারীকে সঙ্গ দেওয়া থেকে ধরে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় থাকা গ্রাহকের পাশেও ছিলেন শোজি। এমনকি বুলেট ট্রেনে চড়ে টোকিও থেকে ওসাকা যাচ্ছেন, এমন এক গ্রাহক তার বিদায় সম্ভাষণের জন্যও স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন শোজি মোরিমোতোকে!
মোরিমোতো মনে করেন, তার গ্রাহকেরা আসলে ওইসব মানুষকে বিরক্ত করতে চান না, যাদের তাদের প্রতি কোনো টান নেই।
তিনি বলেন, "আমার মনে হয়, মানুষ কখনো কখনো খুব অসহায় বোধ করে। তখন তারা ঘনিষ্ঠজনদের ব্যাপারেও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। তারা ভাবতে থাকে, তাকে এই কথাটা বললে সে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে বা আদৌ পছন্দ করবে কিনা। সে কারণেই তারা আমার মতো অপরিচিতকে ডেকে নেয়, যার সাথে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই।"
তবে আগে থেকে জানাশোনা না থাকলেও, কখনো কখনো শোজি তার গ্রাহকদের আবেগীয় মুহূর্তে সমানুভূতি দেখান। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াসুশি ফুজি বলেন, "বিশেষ করে মহামারিকালে মানুষকে অনেক বেশি আইসোলেশনে থাকতে হয়েছে, তখন তারা এমন একজন সঙ্গী খুঁজতো যে তাদের পাশে দাঁড়াবে।"
অধ্যাপক ফুজি আরও বলেন, "বন্ধুবান্ধব এবং অন্যান্য মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেও হুট করে অজানা-অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি চলে আসতে পারে। কিন্তু রেন্টাল-সান বা আগন্তুকের সাথে কথপোকথনের সময় কি ঘটতে পারে তা বুঝে নেওয়া খুব সহজ। সেখানে নিয়ন্ত্রণও আপনার হাতেই থাকে।"
এ ধরনের 'ভাড়াটে আগন্তুক' আরও কয়েকজন আছেন এবং তাদের আলাদা আলাদা কৌশলও আছে। এই যেমন, এদের কারো কারো ডাক পড়ে শুধু খাবারের সময় পাশে থাকতে। কেউবা নিজেকে কুৎসিত বলে আখ্যা দেন অন্যের আত্মমর্যাদাবোধ বাড়িয়ে তুলতে। কিন্তু শোজি 'কিছুই না করা'র বিনিময়ে টাকা নিয়ে নিজের অবস্থান দাঁড় করিয়েছেন! তার এই অভিনবত্বের জন্যই এখন অনেকে তাকে ভাড়া করে।
গতানুগতিক একটি চাকরি হারানোর পর এই অভিনব ভূমিকায় অবতীর্ণ হন জাপানের কানসাই অঞ্চলে বেড়ে ওঠা শোজি মোরিমোতো। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি চাকরিতে যথেষ্ট ভালো পারফরমেন্স দেখাচ্ছেন না এবং সফলতার পথে যথেষ্ট উদ্যোমি নন। কিন্তু এ যাবত শোজি প্রায় ৪০০০ গ্রাহককে সেবা দিয়েছেন এবং দৈনিক তাকে দুয়েকজন গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে হয়। মহামারিকালে তাকে দৈনিক ৩-৪ জনের কাছেও যেতে হতো। শোজি জানান, কিছু না করার মাধ্যমেই তিনি এখন যথেষ্ট আয় করেন। এই টাকা দিয়েই তার সংসার চলে এবং নিজের ছেলেকে বড় করছেন।
"আমাকে প্রায়ই বলা হতো আমি যথেষ্ট উদ্যমী নই বা কাজ করছি না, বা কিছুই করছি না। এটা আমার জন্যে এক রকম কমপ্লেক্স হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমি এখান থেকেই সুবিধা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেই এবং এটাকে ব্যবসায়ে পরিণত করি!" বলেন শোজি।
শোজির নিজস্ব লাইফস্টাইলও তাকে এক্ষেত্রে বেশ সাহায্য করেছে। যখন কাজ করেন না, তখনো তিনি খুব মিতভাষী। নিজের অতি পরিচিত নীল টুপি ও হুডি পরে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এর মাধ্যমেই গ্রাহকেরা দ্রুত চিনে নেয় তাকে। তবে দরকার পড়লে ফরমাল পোশাকেও সজ্জিত হন শোজি।
কিভাবে এই ব্যবসায়ে এত দ্রুত উন্নতি করলেন, তার সঠিক কারণ অনুমান করতে দ্বিধা বোধ করেন শোজি মোরিমোতো। তবে তিনি জানান, মানুষের ভালোমন্দ বিচার করার বদলে তাদেরকে সমানুভূতি দিতে শিখেছেন তিনি।
"বাইরে থেকে মানুষকে খুব স্বাভাবিক-সুন্দর লাগলেও, অনেকেই তা নয়। তাদের অনেক ভয়াবহ অতীত থাকে বা গোপন কথা থাকে, সমস্যা থাকে। অনেক রকম পাগলাটে সমস্যা নিয়ে মানুষ আমার কাছে আসে। তাদের দেখলেই মনে হয় অনেক কষ্টে ভুগছে। প্রত্যেককেই বাইরে থেকে সুখী দেখালেও, প্রত্যেকেরই নানারকম সমস্যা রয়েছে।"
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট