ফড়িং ধরা আর নয় শিশুর খেলা, হয়ে উঠেছে জমজমাট ব্যবসা
মানুষের খাদ্য তালিকা সত্যিই বাহারি। দেশকাল জাতি আর সংস্কৃতি ভেদে কী খায় না মানুষ। কারো কাছে যা সুখাদ্য, অপরের কাছে তাই বিবমিষার শামিল। তেমনি পোকামাকড় খাওয়ার ইতিহাসও অনেক পুরোনো। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের কিছু জাতি খাদ্য পতঙ্গ খায় অনায়সে, ঠিক যেমন আমরা চোখ বুজে খাই- ভাত ও মাছ।
করোনাভাইরাস মহামারির প্রাথমিক কারণ হিসেবে মানুষের এ ধরনের বন্যপ্রাণ ও পতঙ্গকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণকেও দায়ী মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যেই আলোচনায় উঠে এসেছে উগান্ডার মানুষের প্রিয় খাবার– ঘাস ফড়িং। শুধু তাই নয়- চাহিদা ব্যাপক থাকায় তারা এগুলোর উৎপাদন বাড়ানো এবং কীভাবে একসঙ্গে অসংখ্য ঘাসফড়িং ধরা যায় তার কৌশল উদ্ভাবন করছে।
কিন্তু পরিবেশবিদরা বলছেন, ঘাসফড়িংয়ের অতি উৎপাদন ও সংগ্রহ জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে; যা কিনা খাদ্যশস্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ভবিষ্যতে।
উগান্ডায় জনপ্রিয় একটি নাস্তা হল 'ঘাসফড়িং'। এই ঘাসফড়িং বা পঙ্গপালকে স্থানীয়ভাবে 'এনসেনিন' নামে ডাকা হয়। মূলত শীতের শুরুতে যখন আকাশে চাঁদ পূর্ণ থাকে, তখন ফসলের মাঠে এই পঙ্গপালের দল হানা দেয়। তখন তাদের ধরার জন্য স্থানীয়রা ফাঁদ পাতে।
তারা চার-বাই আট-ফুট টিনের শিট দিয়ে ঘেরাও করে বেষ্টনীর মতো তৈরি করে। বাতাস এলে এই বিশাল টিনের শিটগুলোতে ঝাঁকুনি লাগে যা পোকামাকড়ের জন্য ফাঁদের তির্যক দেয়াল তৈরি করে। টিনের দেয়ালটির মধ্যে একটি ৪০০-ওয়াটের বাল্ব লাগিয়ে রাখা হয়। তার কিছুটা দূরে একটি ডিজেল জেনারেটর চালানো হয় যা এই ৪০০-ওয়াটের বাল্বটিকে শক্তি দেয়৷ আলোর অতি রশ্মি মানুষের চোখকে অন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এটি ঘাসফড়িংকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে।
টিনের ধাতব পাতগুলির নিচে কয়েক ডজন খালি ড্রাম দাড় করিয়ে রাখা হয়। যেগুলোতে ঘাসফড়িং ধরে আটকে রাখা হয়।
প্রতিবছর শরৎ ও বসন্তে অর্থাৎ বর্ষা ঋতুর পরে উগান্ডার লোকজন একত্রিত হয় তাদের এই সুস্বাদু ঘাসফড়িং ভাজা খেতে। নোনতা এবং ভাজা ঘাসফড়িং উগান্ডায় বেশ জনপ্রিয় খাবার। সেখানকার বাজার, ট্যাক্সি পার্ক এবং রাস্তার ধারে যা ব্যাগপ্রতি দুই ডলারে বিক্রি হয়। আমেরিকানরা যেমন সিনেমা দেখতে দেখতে পপকর্ন খায়, তেমনি উগান্ডার মানুষের জন্য এই ঘাসফড়িং ভাজা থাকা চাই।
একসময় উগান্ডায় ছোট পরিসরে এবং ব্যাক্তিগত উদ্যাগে ঘাসফড়িং চাষ হতো। চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বাড়ায় এখন এই ঘাসফড়িং চাষ বাণিজ্যিকভাবেও বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বিশাল পাহাড়ের চূড়া এবং ছাদে ফাঁদ পেতে এখন কয়েক টন পোকামাকড় সংগ্রহ করা হয়।
মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া পোকামাকড়ে বেশি মাত্রায় প্রোটিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকায় 'জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা' (ইউএন-ফাও) এগুলোকে "ভবিষ্যতের খাদ্য উৎস" হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ভবিষ্যতে ক্ষুধা এবং অপুষ্টি প্রতিরোধ করে খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে পতঙ্গের প্রোটিন। পোকামাকড় প্রোটিনের উৎস হিসেবে উগান্ডার মতো আফ্রিকান দেশগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটিতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে এবং মহিলাদের এক- তৃতীয়াংশের মধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
কাম্পালার মেকেরের বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা, জীববৈচিত্র্য এবং পর্যটন বিভাগের একজন কীটতত্ত্ববিদ 'ফিলিপ নাইকো' একদল গবেষককে নিয়ে ঘাসফড়িং প্রজনন ও সংগ্রহ পদ্ধতি সম্পর্কিত গবেষণা পরিচালনা করছেন। তার এই গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা বছর ধরে ঘাসফড়িং সরবরাহ কীভাবে করা যায় সেই পদ্ধতি উদ্ভাবন। আর যেসব কৃষকের ফসল কীটপতঙ্গ ও খরার ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে তার সমাধান দেওয়া।
২০১৯ সালে দীর্ঘ আট বছরের গবেষণার পর নাইকো এবং তার দল এক অবিশাস্য কৌশল আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু ২০২০ সালে মহামারির কারণেই কৃষকদের সাথে তার এই পাইলট প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা বিলম্বিত হয়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে প্রকল্পটি আবার শুরু হতে চলেছে৷ এজন্য গবেষকরা ৯৯টি গ্রামকে বেঁছে নিয়েছেন।
মাসাকা বাসেনিন অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের সাবেক প্রধান হাজি কুরাইশ কাতোঙ্গোল মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা উগান্ডাকে উর্বর মাটি এবং অনুকূল পরিবেশ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ আখ এবং তেল শস্য চাষের জন্য জমি তৈরি করতে গিয়ে বন উজাড় করে ফেলাতে পঙ্গপালের আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনও বর্ষাকালকে অপ্রত্যাশিত করে তুলছে যা পঙ্গপালদের প্রকৃতিতে বেঁচে থাকাতে প্রভাব ফেলছে। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে আমূল প্রভাব ফেলবে উগান্ডার ফড়িং চাষি, ব্যবসায়ী আর অন্য ফসল চাষকারী কৃষকদের জীবনেও।