‘হিয়ার উই গো’: যেভাবে ফুটবল সাংবাদিকতার অবতার হয়ে উঠলেন ফাব্রিজিও রোমানো

বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাকে বলা যায়, ফুটবলের পয়গম্বর। আরও সঠিকভাবে বললে, দলবদল বাজারের পয়গম্বর। ফাব্রিজিয়ো রোমানো 'হিয়ার উই গো' বলার আগ পর্যন্ত যেন কোনো দলবদলই নিশ্চিত না।
বর্তমানে টুইটারে রোমানোর ফলোয়ার সংখ্যা ৬৫ লাখের মতো, যা ফুটবল অঙ্গনে তাকে প্রাথমিক খ্যাতি এনে দেওয়া ক্লাব ইন্টার মিলানের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। আর রোমানোকে বিশ্বব্যাপী পরিচয় করিয়ে দেওয়া ব্রুনো ফার্নান্দেসের চেয়েও তার ফলোয়ার সংখ্যা বেশি।
ইনস্টাগ্রামে রোমানোর আরও ৫৬ লাখ ভক্ত আছেন। ফেসবুকে আছেন ৪৫ লাখ। এছাড়া ইউটিউবে প্রায় সাত লাখ এবং ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম টুইচে সাড়ে চার লাখ সাবস্ক্রাইবার আছে এই ইতালীয় সাংবাদিকের।
এখন জানুয়ারি মাস, দলবদলের বাজার খোলা। এই লেখা আপনার হাতে যেতে যেতে এই সংখ্যাগুলো হয়তো আরও বেড়েছে।
অজানা নাম্বারের কল ও রোমানোর উত্থান
রোমানোর শুরুটা এক ধরনের ফ্লুক। ন্যাপলসের অধিবাসী রোমানো কিশোর বয়সেই ফুটবল নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ফুটবল কেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ ও ফিচার লিখে ছোটখাটো স্পোর্টস ওয়েবসাইটগুলোয় পাঠানো শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে কালেভদ্রে দু-একটি লেখা প্রকাশিত হলেও এর জন্য কোনো সম্মানী পেতেন না তিনি।
এসব করতে করতেই একদিন অপরিচিত এক নাম্বার থেকে কল পান রোমানো। বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়ায় কাজ করা এক ইতালীয় ব্যক্তি ফোন করেছেন। তিনি খেলোয়াড়দের এজেন্ট হতে চান। প্রাথমিকভাবে দুই তরুণ ফুটবলারকে রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন সেই ব্যক্তি। তাই রোমানোকে ফোন দিয়েছেন ওই ফুটবলারদের উপর একটি ফিচার লেখতে পারবেন কি না জানতে।
সেই দুই ফুটবলার হচ্ছেন, তরুণ স্প্যানিশ উইঙ্গার জেরার্ড ডেলোফেও এবং প্রডিজি স্ট্রাইকার মাওরো ইকার্দি।
রোমানো লিখেন সেই ফিচার। ডেলোফেও ও ইকার্দিও সেই এজেন্টকে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন। এজেন্টের সঙ্গে নতুন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেন রোমানো।
২০১১ সালের গ্রীষ্মে বার্সা ছেড়ে সাম্পদোরিয়ায় পাড়ি জমান ইকার্দি। আর এই দলবদলের সংবাদ প্রথম প্রচার করেন রোমানো। এখনও গর্ব করে এই দলবদলকে নিজের 'প্রথম সংবাদ' বলে থাকেন রোমানো।
তবে এর প্রভাব ছিল বেশ সীমিত। ইকার্দি তখনো যুবদলে খেলা অপরিচিত এক ১৮ বছর বয়সী স্ট্রাইকার। ইতালির দ্বিতীয় বিভাগের এক দলে তার পাড়ি জমানোটা স্বাভাবিকভাবেই কোনো শোরগোল তোলেনি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে আবার সেই এজেন্ট ফোন করেন রোমানোকে। বলেন, "আমার ক্যারিয়ার শুরু করতে সাহায্য করেছিলে তুমি। এখন আমার পালা।" এজেন্ট জানান, সামনের গ্রীষ্মে ইন্টার মিলানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছেন ইকার্দি।
চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার ছয় মাস আগে রোমানো প্রকাশ করেন এই সংবাদ। ইকার্দির খবর প্রথম জানান ইন্টার মিলানের একটি ফ্যান সাইটে।
এই সংবাদই আসলে রোমানোর জীবন বদলে দেয়। ন্যাপলস ছেড়ে ইতালীয় ফুটবলের অঘোষিত রাজধানী মিলানে পাড়ি জমান তিনি। এবং স্কাই স্পোর্টস ইতালিয়ায় একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ নেন।
দলবদল সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি
খেলোয়াড় দলবদল নিয়ে আলোচনা, খোশ-গল্প ও গুজব; এগুলো সবসময়ই ফুটবল সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ছিল। ইংল্যান্ডের ১৯৩০ সালের ক্রীড়া সংবাদপত্রগুলো ঘাঁটলেও অনেক দলবদলের গুজব খুঁজে পাবেন।
তবে দলবদলকে ঘিরে তৈরি হওয়া সংস্কৃতি সবচেয়ে গাঢ় হয়তো ইতালিতেই। এবং অন্য সব দেশের মতো ইতালির এই দলবদল সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে দৈনিক পত্রিকাগুলোকে ঘিরে।
বহুদিন পর্যন্ত খেলাধুলার খবরের জন্য ইতালিতে শুধু চারটি দৈনিক সংবাদপত্র ছিল। এই পত্রিকাগুলো কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যেত গ্রীষ্মে। কারণ তখন দুই মৌসুমের মধ্যকার ব্রেক চলায় মাঠে কোনো খেলা থাকত না। যে কারণে এ সময়টায় দলবদলের সংবাদের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো পত্রিকাগুলোর।
যেদিন দলবদলের কোনো সংবাদ থাকত না, সেসব দিনে এই সংক্রান্ত গসিপ বা গুজব প্রচার করত পত্রিকাগুলো।
রোমানো যখন স্কাই স্পোর্ট ইতালিয়ায় কাজ শুরু করেছেন, তখন এই বাজারের শীর্ষ প্রতিবেদক ছিলেন জিয়ানলুকা ডি মারজিও। বছরের দুই ট্রান্সফার উইন্ডোতে প্রতিদিন রাতেই দলবদল-কেন্দ্রিক একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন ডি মারজিও।
কাজ শুরু করার কয়েকদিনের মাঝেই ডি মারজিওর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন রোমানো। এই অভিজ্ঞ সাংবাদিককে তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট তৈরি করতে সাহায্য করেন তরুণ রোমানো। বিনিময়ে হাতেকলমে রোমানোকে দলবদল সাংবাদিকতার সব খুঁটিনাটি শিখিয়ে দেন মারজিও।
এ ব্যাপারে রোমানো বলেন, "দলবদলের ক্ষুদ্রতম ইঙ্গিত বা হিন্ট ধরতে আমি প্রতিদিন শহরের চারপাশে ঘুরে বেড়াতাম। ফুটবলের লোকজন মিলিত হয় এমন সব রেস্তোরাঁ, হোটেলে খোঁজ নিতাম আমি।"
রোমানোর প্রজ্ঞা ও দলবদল সাংবাদিকতার নতুন রূপ
সংবাদ খোঁজার বেলায় প্রথাগত ধারা অনুসরণ করলেও রোমানো বুঝতে পারছিলেন মিডিয়ার দৃশ্যপট পরিবর্তিত হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন, তার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন একটি আউটলেট হিসেবে কাজ করতে পারে, তেমনি তথ্যের উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে।
ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম হিসেবে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপযোগিতাও ধরতে পারেন রোমানো।
"উদাহরণস্বরূপ, আমি শুরুর দিকে ইনস্টাগ্রামে আমার ব্যক্তিগত ছবি আপলোড দিতাম। আমি হয়তো একটি সুন্দর সূর্যাস্তের ছবি দিলাম, বা ডিনারের ছবি দিলাম; কিন্তু সেসব ছবির কমেন্ট বক্সেও মানুষ আমাকে দলবদল নিয়ে জিজ্ঞেস করত। আমার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে আসলে কেউই আগ্রহী না," বলেন রোমানো।
"আমি কোনো তারকা না। আমি একজন সাংবাদিক, আমি একজন মধ্যস্থতাকারী।"
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও অনুধাবন করেন রোমানো। তিনি বুঝতে পারেন, নিজেকে ভৌগলিকভাবে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তার পোস্টের কমেন্টে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং স্পেনের ফুটবলভক্তরা আপডেটের জন্য আকুতি জানাতে শুরু করে। ভক্তদের চাহিদা বুঝতে পেরে তিনি ইতালির বাইরে থেকেও তথ্য নেওয়া শুরু করেন।
রোমানোকে সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় ২০২০ সালের এক দলবদল। এর আগের গ্রীষ্মেই প্রতিভাবান পর্তুগিজ মিডফিল্ডার ফার্নান্দেস ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি দিবেন বলে জোড় গুঞ্জন চলছিল। কিন্তু রোমানো তাতে সায় দেননি।
কিন্তু মৌসুম শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ব্রুনোর দিকে ঝুঁকে ক্লাবটি, সিদ্ধান্ত নেয় জানুয়ারি উইন্ডোতে এই পর্তুগিজকে কিনে নেওয়ার। এই দলবদল নিশ্চিত হওয়ার পর রোমানো তার ট্রেডমার্ক 'হিয়ার উই গো' লিখে ঘোষণা দেন। ইউনাইটেড ভক্তদের কল্যাণে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান রোমানো।
এই খবর তিনিই প্রথম প্রকাশ করেছেন, এমন দাবি করেন না রোমানো।
আগের কয়েক মাস ধরেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ব্রুনোর গুঞ্জন। এবং চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই এর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল সংবাদমাধ্যমগুলো।
রোমানোর মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কত আগে সংবাদ নিয়ে এলো, এর উপর সেই সাংবাদিককে মূল্যায়ন করা হয় না। বিশেষ করে ফুটবলের বিশৃঙ্খল, পরস্পরবিরোধী এবং গুজবে ভরা দলবদল বাজারের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই না।
"মানুষ জানতে চায় তারা যা পড়ছে তা সত্য কি না। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে এটির অগ্রাধিকার বেশি তাদের কাছে," বলেন রোমানো।
"এবং এটিই দেওয়ার চেষ্টা করি আমি। আমার কোনো ডেডলাইন নেই, পত্রিকা বিক্রি করতে হবে এমন কোনো তাড়াও নেই। তাই কেবল তথ্য প্রস্তুত থাকলেই আমি তা প্রকাশ করি।"
এই নৈতিকতার জন্যই মূলত রোমানোর প্রভাব এতো দ্রুত বেড়েছে এবং বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত ১৮ মাসেই ৫০ লাখের বেশি ফলোয়ার পেয়েছেন তিনি।
স্কাই স্পোর্টসের পাশাপাশি এখন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম 'দ্য গার্ডিয়ান' এবং মার্কিন চ্যানেল 'সিবিএস স্পোর্টস'-এ কাজ করেন রোমানো। এসব গণমাধ্যমে দেওয়ার পাশাপাশি দলবদলের যেকোনো আপডেট নিজের টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং ইউটিউবেও আপলোড করেন তিনি। পাশাপাশি নিজের পডকাস্ট এবং টুইচ চ্যানেলেও প্রতিনিয়ত করেন দলবদল নিয়ে আলোচনা। এই বাজার নিয়ে একটি বই লেখার চিন্তাও করছেন রোমানো।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।