হাতিরঝিল বোট সার্ভিস: যে পথে যানজট এড়িয়ে মনোরম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গন্তব্যে যাওয়া যায়
সেদিন আমার খালাতো ভাই সজিব চাকরির পরীক্ষা দিতে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসে উপস্থিত হয়। কারওয়ান বাজারে এক বন্ধুর মেসে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সজিব পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ঢাকার যানজট সম্পর্কে জেনেছিল। তবে সেবার আসার সময় তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমায় বললো তার পরীক্ষার সিট পড়েছে বাড্ডার একটি হাইস্কুলে। পরীক্ষার সময় দুপুর ০৩ টায় শুনে আমি ওকে ঢাকার ওয়াটার বোট সার্ভিসের বিষয়ে জানাই। ওয়াটার বোটের মাধ্যমে দ্রুতই পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারবে বলে আশ্বস্ত করেছিলাম ওকে।
আমাদের প্রিয় ঢাকার কথা বললেই আমাদের কল্পনায় যে অপ্রিয় বিষয়টি আসে তা হলো যানজট। ঢাকার এই যানজটের তীব্রতা সম্পর্কে প্রায় সকলেই ওয়াকিবহাল। যানজট প্রায়শই অসহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। বিপাকে পড়ে যান অপেক্ষারত হাজার হাজার যাত্রীরা। যানজটের এই অত্যাচার এড়াতেই মূলত সজিবকে ওয়াটার বোটে করে বাড্ডা যেতে পরামর্শ দিই।
সজিবের সাথে আমিও পরীক্ষা কেন্দ্রে রওনা হই। বেলা এগারোটায় আমরা বের হই। যেহেতু আমি নিজেও এতদিন হাতিরঝিল ওয়াটার বোটে উঠিনি, তাই আমার মধ্যেও এক প্রকার উত্তেজনা কাজ করছিল। আমরা রিক্সা নিয়ে কারওয়ান বাজারের অদূরে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) দিকে যাই। এখানে হাতিরঝিল ওয়াটার বোটের একটি ঘাট 'জেটি-০১' অবস্থিত। আমরা পৌঁছে টিকিট কাউন্টারে গেলাম। বাড্ডা যেতে আমাদেরকে জনপ্রতি ৩০ টাকার টিকিট কাটতে হলো। এছাড়া এফডিসি হতে পুলিশ প্লাজা, নিকেতন, রামপুরা, বনশ্রী পর্যন্ত জনপ্রতি ২০ টাকা করে ভাড়ার তালিকা টানানো দেখলাম।
যাইহোক, টিকিট নিয়ে আমরা বোটে উঠে পড়ি। কোভিড মহামারির জন্যে আমাদের সকলকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক এবং অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে লাইফ জ্যাকেট পড়তে বলা হলো। নৌকায় বসে হাতিরঝিলের চারপাশের অসামান্য সৌন্দর্য দেখছিলাম। মাত্র ১৫ মিনিটেরও কম সময়ে আমরা বাড্ডা হাইস্কুলের বিপরীতে অবস্থিত গুদারাঘাটে পৌঁছে গেলাম। পরীক্ষা শেষ হলে ফেরার সময়ও আমরা জলপথ বেছে নিলাম। কারণ, তখন রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। পরীক্ষার্থীদের কারণে বাসগুলোতে পা ফেলার জায়গা নেই। এমতবস্থায় বোটে করেই ফেরাটাই উচিত মনে হলো। তখন বিকাল প্রায় ৫টা বেজে গেছে। অফিস ফেরত মানুষেরা ধীরে ধীরে গুদারাঘাটে ভীড় করছে। নৌকায় যাতায়াতের জন্য এত মানুষের ভীড় দেখে দ্রুতই টিকিট কেটে নৌকায় উঠে পড়ি। জেটি-০১ এ পৌঁছে সজিব আর আমি চারপাশটা ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করলাম। এ সূত্রেই বোট সার্ভিসের জেটি-০১ এর দায়িত্বরত কর্মকর্তা তালিম হোসেনের সাথে কথা বলি। তিনি চা খেতে খেতে তার কাজের অভিজ্ঞতা জানালেন আমাদের।
ঢাকার ওয়াটার বোট সার্ভিস
রাজধানীর হাতিরঝিলের কথা কমবেশি সবাই জানি। রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলের যোগাযোগকে সহজ করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০১৩ সালে হাতিরঝিল প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি ৩০২ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বরে হাতিরঝিলে ওয়াটার বোট সার্ভিস চালু করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাবাসীর বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে হাতিরঝিলকে এক ধাপ এগিয়ে নেয়া। রাজউক এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রকল্পটি।
তালিম হোসেন জানালেন, হাতিরঝিল ওয়াটার বোট সার্ভিসের বর্তমান পরিচালনার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান করিম গ্রুপকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০ বছর এই প্রকল্পটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা করবে। বর্তমানে এফডিসি, পুলিশ প্লাজা, গুলশান, মেরুল বাড্ডা এবং রামপুরায় ওয়াটার বোটের ঘাটগুলো অবস্থিত। এফডিসির 'জেটি-০১' এ মোট ১৫ টি নৌকা রয়েছে। এখান থেকেই যাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় যান'।
হাতিরঝিল ওয়াটার বোট সার্ভিসের সরাসরি সুবিধা পাবেন বাংলামোটর, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, আফতাবনগর, উলন, বাড্ডা, মগবাজার, এবং গুলশানসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় বাসিন্দারা।
নৌকাগুলো কেমন?
নৌকার দ্বায়িত্বে থাকা মাসুম হোসেন জেটির এক পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। তার সাথেও কিছুক্ষন আলাপ হলো। নৌকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'নৌকাগুলো ফাইবার দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এই নৌকাগুলোর বডি অন্যান্য নৌকার তুলনায় কমপক্ষে দশগুণ স্থায়ী। পাশাপাশি এটি যাতে কোনোমতেই ডুবে না যায় এজন্য আলাদা ডিজাইন করে বানানো এগুলো। আমাদের ডেকে নিয়ে দেখালেন, নৌকার পেছনের অংশটা সাধারণ নৌকার মতো কোনাকৃতির নয়, বেশ কিছুটা চওড়া। নৌকার এই চওড়া অংশ নৌকার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে যাত্রীদের স্বাভাবিক নড়াচড়াতে নৌকাগুলো দুলবে না।
এ সময় তালিম হোসেন নৌকাগুলো দেখিয়ে বলেন, 'নৌকাগুলো যথেষ্ট খোলামেলা। এজন্যই নৌকার ভিতরে বসে অনায়াসেই চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছেন আপনারা। নৌকাগুলো সক্ষমতার থেকে বেশ কম গতিতে চালানোর নির্দেশ দেওয়া আছে। কারণ, খুব দ্রুত বেগে নৌকা চাললে তা জলাশয়ের দুই পাড় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া, নৌকা কম গতিতে চললে যাত্রীরা হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক দৃশ্যও উপভোগ করতে পারবেন'।
জেটি ঘাটের সাথেই একটি 'বোট ওয়ার্কশপ' রয়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটিসহ যেকোনো ক্ষতিগ্রস্ত নৌকা এখানে মেরামত করা হয়। আকৃতিতে তুলনামূলক বড় একটি নৌকা দেখতে পেলাম সেখানে। মাসুম হোসেন জানালেন, এটির নির্মাতা তিনিই। গত সপ্তাহে নৌকাটি চালু করতে গেলে ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। তারপর থেকে এটি ওয়ার্কশপেই আছে। ইঞ্জিন বিকল হওয়া এই নৌকাটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন। অন্য নৌকাগুলো আকারে বেশ ছোট। ফাইবার নির্মিত এসব ছোট আকৃতির নৌকাগুলো মোট ৩২ আসন বিশিষ্ট।
ওয়াটার বোট সার্ভিসের নিরাপত্তা
প্রতিটি নৌকাতেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী আছে। এসব সামগ্রী ব্যবহার নিয়ে তালিম হোসেন অভিযোগের সুরে বললেন, 'প্রতিটি যাত্রীকেই বাধ্যতামূলক লাইফ জ্যাকেট পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, অনেকেই এ নির্দেশ মানেন না'। এর কারণ কি জানতে চাইলে বললেন, 'অধিকাংশ যাত্রীই খুব দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যান। এত অল্প সময়ের জন্য তারা কেউ লাইফ জ্যাকেট পরাকে অবশ্যিক কিছু মনে করেন না'।
নৌকার কারিগর মাসুম হোসেন একটু এগিয়ে এসেই জানালেন যে হাতিরঝিলের পানির গভীরতা খুব বেশি না। কোথাও ৮ ফুট আবার কোথাও ১৫ ফুটের মতো। মূলত বিনোদন কেন্দ্র হিসাবেই এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে যাত্রীদের যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার্থে এবং বিনোদনের অংশ হিসাবে ওয়াটার বোট সার্ভিসকে প্রকল্পের অংশ করা হয়। এছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে আছে রেড ফোর্স এবং বিশেষ উদ্ধারকারী দল।
অন্যান্য যাত্রীরা কী বলেন?
আমাদের গল্প চলাকালেই দুটি নৌকা এসে ঘাটে ভীড়লো। পরিচিত এক ভাইকে নৌকা থেকে নামতে দেখলাম। জানতে পারলাম তিনিও পরীক্ষা শেষ করেই আসলেন। অনেকদিন ধরেই এই পথে যাতায়াত আছে তার। কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞাসা করলাম লাইফ জ্যাকেট সম্পর্কে। বললেন, 'মাত্র দশ মিনিটের জন্য জ্যাকেট পড়ে কি করবো? নামার সময় এটি খুলতেই দুই মিনিট লেগে যায়'। অকাট্য যুক্তি বটে!
কোলে শিশুবাচ্চা নিয়ে আরেক ব্যক্তিকে দেখলাম আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম নৌকায় মাঝপথে দুর্ঘটনায় পড়লে কি করবেন? উত্তর দিলেন, 'এখানে আগেও ভ্রমণ করতে এসেছি। প্রতিবারই আমরা লাইফ জ্যাকেট পরে নিই। এছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নি। ভাড়া কিছুটা বেশি হলেও ঢাকার মধ্যে এমন পরিবেশের সান্নিধ্যে আসতে পেরে কখনোই খারাপ লাগেনি'।
নৌকায় ঘুরতে আসা একদল কলেজ শিক্ষার্থী পেয়ে গেলাম। আলাপ করে জানতে পারলাম তাদের এক বন্ধুর জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে এখানে আসা। এজন্য তারা ছোট একটি নৌকা ভাড়া করেছেন।
মাসুম হোসেন জানালেন, 'এরকম একটি ছোট আকৃতির নৌকা আধা ঘন্টার জন্য ভাড়া করতে ২৫০০ টাকা খরচ হবে। তবে, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ভাড়া কিছুটা শিথিল করা হয়। প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ওয়াটার বোট সার্ভিস চালু থাকে। প্রতি ঘণ্টায় একটি নৌকা সর্বোচ্চ ১২০ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারে। এ হিসাবে ১৫টি নৌকা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার যাত্রী সেবা দেয়া সম্ভব। কিন্তু প্রতিদিন আমরা মাত্র ৬০০০ টিকিট বিক্রি করে থাকি'। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ টাকার ব্যবসা হচ্ছে বর্তমানে।
কথা বলে জানা গেলো, কোভিড পরিস্থিতিতে দিনের বেশিরভাগ সময়ই নৌকাগুলো ফাঁকা থাকে। শুধু অফিস আওয়ারেই যাত্রীদের চাপ থাকে অতিরিক্ত। আবার, ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসা যাত্রীর সংখ্যাও খুব বেশি না। এক রকম যাত্রী সংকটের কারণেই মেরুল বাড্ডার ঘাটটি আপাতত বন্ধ আছে। ঢাকার অন্যান্য ব্যস্ত রুটগুলোর সাথে যদি ওয়াটার বোট সার্ভিস সংযুক্ত করা যায় তাহলে নগরবাসী ট্রাফিক জ্যামের অভিশাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পাবে বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।