যে কারণে বিশ্বের সেরা ভবনের খেতাব জিতলো বাংলাদেশের হাসপাতাল
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাতক্ষীরার জলাবদ্ধ ভূমিতে গড়ে উঠেছে নতুন এক হাসপাতাল। ঘূর্ণিঝড় কবলিত এই এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নির্মিত এ হাসপাতাল জিতে নিয়েছে বিশ্বের সেরা নতুন ভবনের খেতাব।
নূন্যতম সম্পদের সাহায্যে নির্মিত পরিবেশবান্ধব এই ভবনটি স্থপতি ডেভিড চিপারফিল্ড নির্মিত বার্লিনের একটি গ্যালারি এবং ডেনমার্কে উইলকিনসন আইরি নির্মিত ফুটব্রিজকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে এ পুরস্কার জিতেছে।
'ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল' হিসেবে পরিচিত হাসপাতালটির স্থপতি ঢাকা-ভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আরবানার পরিচালক কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
বিশ্বে কম খরচে ব্যতিক্রমী নকশায় নির্মিত ভবন ও ভবনের স্থপতিকে এই পুরস্কারে ভূষিত করে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা)। সংস্থাটির জুরি বোর্ড জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে ন্যূনতম সম্পদ ব্যবহার করে এই হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। তাই অন্য ভবনগুলোর তুলনায় এটি ব্যতিক্রম।
সাতক্ষীরা জেলা এবং এর আশেপাশের জনগোষ্ঠীর জন্য নির্মিত ৮০ শয্যার এ হাসপাতালটির চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ১০ ফুট প্রশস্ত আঁকাবাঁকা খাল। গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে ভবনের ভেতরের খালগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খাল ছাড়াও ভবনের প্রতিটি ছাদে ও উঠানে বৃষ্টির পানি ধারণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট থাকায় বর্ষাকালে স্থানীয়রা বিশুদ্ধ পানির সংরক্ষণের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। এ কারণেই কাশেফ চৌধুরী ভবনটির নকশা করেছেন এমনভাবে। জমে থাকা এই পানি সংরক্ষণের জন্য ভবনের উভয় পাশে দুটি স্টোরেজ ট্যাঙ্কও রয়েছে।
হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরের জন্য রয়েছে দুটি আলাদা জায়গা। দুটি জায়গার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দুই রকম। এ কারণে পুরো ভবনকে দুটি ভাগ করতে হয়েছে। তবে, জায়গা স্বল্পতার কারণে ভবনের ভেতর দিয়ে প্রাচীর দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান স্থপতি কাশেফ চৌধুরী। এ কারণে ১০ ফুট চওড়া একটি জলাধারের মাধ্যমে ইনডোর এবং আউটডোরকে আলাদা করা হয়েছে।
পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ভবনটিতে। সেইসঙ্গে নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুতের সর্বনিম্ন ব্যবহার। হাসপাতালের নিরাপত্তা ও সহজে যাতায়াত ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
রিবা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের গ্র্যান্ড জুরি চেয়ার এবং স্থপতি ওডিল ডেক ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালকে 'মানুষের জন্যে ডিজাইন করা একটি বিল্ডিং' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভবনে স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী উপাদানের যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ওডিল বলেন, "তুলনামূলকভাবে পরিমিত বাজেট এবং কঠিন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভালো ডিজাইনের মাধ্যমে কত সুন্দর স্থাপত্য তৈরি করা যায় তার নিদর্শন এটি।"
১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালটি। ২০১৪ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পর ২০১৮ সালে শেষ হয়। তখন থেকেই সাতক্ষীরার মানুষের উপকারে আসছে এটি। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন পূরণ করার পাশাপাশি এই অঞ্চলের পানির ঘাটতি পূরণে ভূমিকাও রাখছে ভবনটি।
২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই স্থাপনা। স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত হাসপাতালে আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও রয়েছে অডিটরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যানটিন ও প্রার্থনাকক্ষ।
চিকিৎসক-নার্সসহ ৫৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সুবিধা হাসপাতালটিতে। রয়েছে অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। সবধরনের রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় এখানে। ৮০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে রয়েছে সার্জারির ব্যবস্থা।
হাসপাতালের ডিজাইন নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কাশেফ চৌধুরী বলেন, "সবারই ধারণা থাকে হাসপাতাল একটি যন্ত্রের মত। একদিক দিয়ে রোগী ঢুকবে, তাদের চিকিৎসা হতে থাকবে আর অন্যদিকে বর্জ্য বেরিয়ে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু আমরা সেখানে আটকে থাকিনি, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, আলো বাতাস কীভাবে থাকবে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কীভাবে থাকবে এসব দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক দিক বিবেচনা সুন্দর একটা জায়গা দেওয়ার চিন্তা করেছি।"
তবে, এই অভিনব ধাঁচের ডিজাইন কাশেফ চৌধুরীর জন্য নতুন নয়। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা ভবন ডিজাইন থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত ভবন ডিজাইন করে আসছেন তিনি অনেকদিন ধরেই।
এর মধ্যে একটি হল উপকূলীয় শহর কুয়াকাটায় নির্মিত কংক্রিটের সর্পিল এক টাওয়ার। এলাকার মানুষেরা ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই ভবনে অবস্থান নিতে পারেন। এমনকি গবাদি পশু রাখার সুব্যবস্থাও রয়েছে ভবনে।
পুরস্কার গ্রহণের সময় কাশেফ চৌধুরী বলেন, গ্রামীণ এবং পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় এই ধরনের কাজে অন্যান্যদের উৎসাহী করবে এই স্বীকৃতি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "ভবনটি নিয়ে কাজ করার আগে বা নির্মাণের সময় অবশ্যই চিন্তা করিনি এটি বিশ্বসেরা খেতাব অর্জন করিয়ে দিবে। এটি আমার জন্য নয় আমাদের দেশের জন্য বড় প্রাপ্তি।"
"দেশের জলবায়ু সংকট পৃথিবীর কাছে তুলে ধরাটা একটা কঠিন কাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বহিঃবিশ্বের মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। তবে এই হাসপাতালটির মধ্য দিয়ে তারা খুব সহজেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং তার স্বীকৃতিও দিয়েছেন," যোগ করেন তিনি।
হাসপাতালটির মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন কাশেফ চৌধুরী।
- সূত্র: ফাস্টকোম্পানি ও দ্য গার্ডিয়ান