তালপাতা: আমলাতন্ত্রের জালে আটকে আছে নাসা প্রকৌশলীর ১২ হাজার টাকার ল্যাপটপ তৈরির স্বপ্ন
প্রায় চার বছর আগে নাসার (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাসান রহমান ছুটিতে আসেন বাংলাদেশে। তার বন্ধু তখন গাজীপুরের বাশবাড়ির একটি স্থানীয় স্কুলে তাকে ঘুরতে নিয়ে যান। তার উপস্থিতি স্কুল প্রাঙ্গণে যেন প্রাণ এনে দিয়েছিল।
নাসার প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা করতে সকল শিক্ষার্থীই ছিল উচ্ছ্বসিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হাসান রহমানের অনুভূতি একই রকম ছিলনা। স্কুলের শিশুরা যে প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত, সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে, তার বন্ধুর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের স্কুলগুলোতে কতখানি প্রযুক্তির অভাব রয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে বদলাতে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তা ভাবতে শুরু করলেন হাসান রহমান। অবশেষে, তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে 'তালপাতা' নামের একটি ল্যাপটপ উদ্ভাবনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপর যেই ভাবনা, সেই কাজ। সঙ্গেসঙ্গে তিনি একটি পরিকল্পনা তৈরি করলেন এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিলেন।
তিন বছরের গ্যারান্টিসহ মাত্র ১২ হাজার টাকায় একটি ৩৬০-ডিগ্রি মাল্টি-টাচ স্ক্রিন ফোল্ডেবল ল্যাপটপ ডিজাইন করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ল্যাপটপটি ফায়ার, ওয়াটার ও সাটারপ্রুফ। অর্থাৎ আগুন, পানি কিংবা হাত থেকে পড়ে গেলেও এর তেমন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এছাড়া, ৮ ঘন্টা ব্যাটারি ব্যাকআপ, ১২৮জিবি স্টোরেজ ও ৮জিবি র্যামসহ ল্যাপটপটির আকার ১১.৬ ইঞ্চি। ইন্টেল এন৪০০০ প্রসেসর রয়েছে ল্যাপটপটিতে, যার মাধ্যমে উইন্ডোজ কিংবা লিনাক্স-ভিত্তিক উভয় অপারেটিং সিস্টেমেই এটি চলতে পারে।
তালপাতা ল্যাপটপ তৈরি করতে তিনি হাই-টেক পার্কের সহায়তা নেন, কারণ তিনি তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করেছিলেন। প্রতি বর্গফুট মাসিক ১০ টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি, যেখানে গুলশানের মতো জায়গায় প্রতি বর্গফুট ভাড়া হয় ১২০ টাকায়।
সরকারের 'ওয়ান-স্টপ সলিউশন' খ্যাত হাই-টেক পার্কের আওতায় আসা যেকোনো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির জন্য রয়েছে ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক ছাড়ের সুবিধা। সুতরাং, পরিকল্পনার অনুযায়ী তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন। তালপাতাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে তিনি বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের অর্ডার দিলেন।
মূলত তখন থেকেই ডেটাসফট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি ইঙ্ক লিমিটেড (ডিএমএ) ল্যাপটপটি 'শীঘ্রই' বাজারে আনার পরিকল্পনা করছে। তবে, সেই 'শীঘ্রই' এখনও আসেনি। ডিএমএ মাত্র ৫০০ ইউনিট ল্যাপটপ তৈরি করতে পেরেছে; কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য তাদের এখনও কোনো পরিকল্পনা নেই।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান রহমান বলেন, "আমাদের টেক ডিভাইসের (প্রযুক্তি) চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমি এই ল্যাপটপটি ক্যান্ডির মতো বিক্রি হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে আমি যেই সমস্যাগুলোর শিকার হয়েছি, তা সমাধানের জন্য আমি ল্যাপটপ উৎপাদনের পরিবর্তে লড়াই করে যাচ্ছি।"
শুরুতে তালপাতার কাঁচামাল বন্দরে আসার পর, হাসান রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহায়তা পাওয়ার আশা করেছিলেন। তবে, যখন তিনি জানতে পারলেন তাকে কাঁচামাল আমদানি বাবদ ৪৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে, তখন তার আশা ভেঙে গেল। কারণ শুরুতে তিনি জানতেন, এর জন্য তাকে কেবল ১ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। উচ্চ শুল্কের কারণে তালপাতার বাজার মূল্য হয়ে গেল দ্বিগুণ।
হাসান রহমান বলেন, "বাস্তবে হাই-টেক পার্কের সব প্রতিশ্রুতি সত্যি ছিলনা। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, কেবল কাঁচামাল আমদানির জন্য আমাকে এত বড় অঙ্কের শুল্ক দিতে হবে, যেখানে অন্যদের অ্যাসেম্বল করা (সম্পূর্ণরূপে তৈরিকৃত) ল্যাপটপ আমদানি করতে মাত্র ৯ শতাংশ চার্জ দিতে হয়।"
"এটি কি ধরনের নীতি? এ ধরনের নীতিমালা কীভাবে ব্যবসায়বান্ধব হতে পারে?", প্রশ্ন করেন তিনি।
এনবিআর'র মতে, হাসান রহমানের কারখানা এনবিআর ও বুয়েটের সমন্বিত বিশেষ কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষিত ও সার্টিফাইড (প্রত্যয়িত) নয়। তাই তিনি ১ শতাংশ শুল্কের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। এছাড়া এনবিআর আরও জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অডিটের পর তার কোম্পানিকে সার্টিফাইড করা হবে। তবে, প্রতিটি অডিটে খরচ হবে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। এরপর কেবল যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেই তিনি ১ শতাংশ শুল্ক পরিশোধের সুবিধা পাবেন, কাঁচামালের ক্ষেত্রে নয়।
হাসান রহমানের ভাষায়, "এখানে যোগাযোগের অভাব রয়েছে। কারণ হাই-টেক কর্তৃপক্ষ আমাকে এসব নীতিমালা বা পদ্ধতির কোনোটি সম্পর্কেই অবহিত করেনি, যা আমাকে পূরণ করতে হবে। আমি হাই-টেক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সার্টিফাইড হওয়ায়, ধরেই নিয়েছিলাম আমার কারখানা অনুমোদনের সমস্ত অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।"
যখন তিনি এই সমস্যাগুলো নিয়ে হাই-টেক কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেন, তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিজের সমস্যাগুলো নিজেকেই সমাধান করার পরামর্শ দেয় তারা; কারণ তখন এটি আর হাই-টেক কর্তৃপক্ষের মাথাব্যাথার কারণ ছিলনা। এমনটিই দাবি করেছেন হাসান রহমান।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। বিএইচটিপিএ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, "আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। যদিও এটি আমার করার কথা নয়। আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছি, এর একটি সমাধান খুঁজে পেতে যেন কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সাহায্য করে।"
এনবিআরের ফার্স্ট সেক্রেটারি (কাস্টমস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড এগ্রিমেন্ট) খায়রুল কবির মিয়া বলেন, "বিএইচটিপিএ যদি তাদেরকে সহযোগিতা না করে থাকে, সেটি আমাদের দোষ নয়। আমরা আমাদের দায়িত্বের প্রতি সৎ। তারপরও যদি কারো কোনো পরামর্শ থাকে, তাহলে তারা জানাতে পারেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা আলাপের জন্য প্রস্তুত।"
দুই বছরের সংগ্রামের পর, চলতি বছররের এপ্রিলের মধ্যে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন হাসান রহমান।
তিনি বলেন, "এনবিআর হয়তো বুঝতে পেরেছে, তাদের নীতিমালা আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য বাধা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই করছে না। এখানে আমি হলাম 'গিনিপিগ', সবার জন্য এই পথটিকে সহজ করতে কাজ করছি।"
কিন্তু ব্যবসায়ীরা কি অন্য কোনো সমাধান খুঁজে পেতে পারে না, যেহেতু ইতোমধ্যেই বিদ্যমান স্থানীয় টেক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব পণ্য তৈরি করছে? এই প্রশ্নের জবাবে হাসান রহমান বলেন, "এটিও কঠিন। কারণ ওয়ালটনের মতো বড় কোম্পানি তার সার্টিফিকেশনের জন্য ১৬ লাখ টাকা দিতে পারে; কিন্তু আমার পক্ষে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা দেওয়া অতটা সহজ নয়।"
একরাশ হতাশা নিয়ে হাসান রহমান আরও বলেন, "আমি কোনো বড় ব্যবসায়ের মালিক নই, তাই আমার আরও সাহায্য-সমর্থন দরকার। পশ্চিমা দেশগুলোতে সমস্ত মানদণ্ড পূরণের পর ছোট টেক কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতে বিনামূল্যে অডিট ও সার্টিফিকেশন করা হয়।"
"ফলস্বরূপ, কোম্পানিগুলো একবার মুনাফা করতে শুরু করলে ট্যাক্স ও ভ্যাট দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যবসায়ের প্রতি প্রতিকূল। আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ নেওয়া হয়, যা পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরও ব্যয়বহুল এবং জটিল করে তুলেছে", আরও বলেন তিনি।
বিএইচটিপিএ-এর বিকর্ণ ঘোষও হাসান রহমানের মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, অডিট কমিটিতে শুধু বুয়েটেরই কর্তৃত্ব থাকা উচিত নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করা উচিত।
তিনি বলেন, "এভাবে সিস্টেমটি আরও স্বচ্ছ, কম সময়সাপেক্ষ ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সাশ্রয়ী হতে পারে।"
হাসান রহমান মনে করেন, এই ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য এই খাতে কর্মরত ব্যক্তিদের নীতিমালা এবং একে অপরের সঙ্গে আরও পরিচিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
"অন্যথায়, তাদের কেউই এ ধরনের সমস্যায় পারস্পরিক সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন না", তিনি আরও বলেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপনকালে হাসান রহমান জানিয়েছেন, ডিএমএ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ৬০:৪০ অনুপাত বজায় রাখার পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, "যদি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হয়, তাহলে আমরা চলতি বছরেই সৌদি আরব, মিশর ও আফ্রিকাতে ল্যাপটপ রপ্তানি করব।"
টেক ও মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর নীতিমালার ভিন্নতা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন হাসান রহমান। অনেক আন্তর্জাতিক মোবাইল কোম্পানিই বাংলাদেশে তাদের ফোন অ্যাসেম্বল করে এবং সেই সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু টেক কোম্পানিগুলো তাদের মতো সুবিধা পায়না, কারণ তারা আইটি বিভাগের অধীনে পড়েছে। ফলে তাদেরকে অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়।
তিনি মনে করেন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার অ্যাসেম্বলকারী টেক কোম্পানিগুলোরও একই ধরনের সুবিধা পাওয়া উচিত।
হাসান রহমানের বিশ্বাস, বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে, বাংলাদেশ ডিএমএসহ শীর্ষ প্রযুক্তি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথম পছন্দ হয়ে উঠবে।