ঢাকার সেরা কাটলেট আর ক্রামচাপ খেতে হলে…
পা রাখতেই দেখা যাবে বাম পাশে বসে আছেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। নাম তার অনিল মিত্র। ১৯৭৬ সালে ক্যাফে কর্ণারে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেবার পর থেকে আজ অবধি তিনিই দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। অনিল মিত্র আর এই রেস্তোরাঁ যেন একে অপরকে প্রতিনিধিত্ব করছে। কারণ বয়স আর অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনিল মিত্র এবং রেস্তোরাঁটি- উভয়ের ঝুলিতেই জমা হয়েছে অনেক গল্প আর ইতিহাস।
পাকিস্তান আমলে স্থাপিত এই রেস্তোরাঁটির নাম ক্যাফে কর্ণার। 'কর্ণার' নামটির সঙ্গে মিলিয়েই যেন এটি স্থাপিত হয়েছে নর্থব্রুক হল রোডের চৌরাস্তার এক কোণে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদরঘাটের দিকে এগোতেই বাংলাবাজার। ডানে পাটুয়াটুলি রেখে, বাংলাবাজারের সড়ক ধরে বাম দিকে এগোতেই চোখে পড়বে ঢাকা সদর প্রধান ডাকঘরের কার্যালয়। এর সামনের রাস্তাটির নামই নর্থ ব্রুক হল রোড, যেখানে অবস্থিত ৫৬ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান।
বয়স আর ঐতিহ্যের দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করালে ঢাকার অন্যতম একটি রেস্তোরাঁ হিসেবে জায়গা করে নেবে এই ক্যাফে কর্ণার। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও রেস্তোরাঁর ভিতরের আয়তন কিন্তু একেবারেই ছোটো। একেবারেই সাধারণ ছিমছাম একটি রেস্তোরাঁ এটি। অনাড়ম্বর দোকানটির ভেতরে হাতেগোনা কয়েকটি টেবিল পাতা। কিন্তু এসবের জন্য কিন্তু গ্রাহকদের ভিড় কোনো অংশে কমেনি।
এখানকার বিখ্যাত ক্রাম চাপ আর চিংড়ি চাপ, মোগলাই, ধোঁয়া ওঠা গরম গরম চায়ের লোভে গ্রাহকদের আনাগোনা চলতেই থাকে সকাল থেকে রাত অবধি। ফলে বসার জায়গা পেতে হলে আপনি গিয়েই কোনো জায়গা পেয়ে যাবেন এই আশা করা ভুলই হবে। এত লোকের আনাগোনা থাকে যে প্রায়ই অপেক্ষা করতে হয় কাউকে না কাউকে।
মানুষ এখানে কিন্তু শুধু খেতেই আসে না, ক্যাফে কর্ণারকে একটি আড্ডাস্থল বললেও ভুল হবে না। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ প্রায় প্রতিদিনই কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঢুঁ মেরে যান এখানে। একদিকে যেমন মোগলাই, ক্রাম চাপ, ধোঁয়াওঠা চা, চিকেন আর চিংড়ির কাটলেটের অর্ডার চলে, অন্যদিকে সমান তালে চলে গালগল্প, হাসিঠাট্টা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য, ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। রেস্তোরাঁর আদি পরিবেশ আর মানুষের দেদারসে খাওয়া আর আড্ডার সম্মিলন দেখে আপনার ক্যাফে কর্ণারকে কলেজ স্ট্রিটের এক টুকরো কফি হাউজও মনে হতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বাচ্চু ক্যাফে কর্ণারে আসছেন ১৯৭৮ সাল থেকে। নোয়াখালী থেকে এসে বাচ্চু ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসেই ভক্ত হয়ে ওঠেন এই 'বনিয়াদী' রেস্তোরাঁর।
বাচ্চু ভাই বলেন, 'এখানকার চা, পরোটা, কিমাভরা আলুর চপ, ভাজি, ডাল, বিভিন্ন রকমের চাপ, খাসি ভুনা, ডিম, চিকেন ফ্রাই, মোগলাই, এমনকি মোরগ পোলাওয়ের স্বাদও মুখে লেগে থাকার মতো। তবে মোরগ পোলাও ক্যাফে কর্ণারের মেন্যুতে যোগ হয়েছে অনেক পরে।'
ক্রাম চাপ তো রয়েছেই, ক্যাফে কর্ণারের চা বাচ্চুর বিশেষ প্রিয়।
রেস্তোরাঁর পেছনের ইতিহাস জানতে চাইলে স্মৃতি হাতড়ে বাচ্চু সাহেব আমাদের জন্য যেন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন।
"এই নর্থ ব্রুক হল বা লাল কুঠি সব তো ছিল ইংরেজদের শাসনাধীন। তারাই মূলত এদেশের মানুষের কাছে খাবারের এই আইটেমগুলো জনপ্রিয় করে তোলে। বাঙালি কারিগররা তাদের মাধ্যমে ক্রাম চাপ, চিকেন ফ্রাই, কাটলেট ইত্যাদির রেসিপি শেখে। সেসময় এই এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। মুসলমান বা খ্রিস্টান বলতে গেলে ছিলই না। ইংরেজরা চলে যাবার পর এই এলাকা আর মানুষজনের জীবনযাপন পদ্ধতিও বদলে গেছে।"
বিগত ৪৩ বছর ধরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকে যিনি এখানকার কাটলেট-চাপে মন ভজিয়ে রেখেছেন তার কাছে জানতে চাইলাম, এত বছরে খাবারের স্বাদে কোন পরিবর্তন পেয়েছেন কিনা। বাচ্চু জানালেন, "সামান্য হেরফের হলেও মূল স্বাদ আগের মতোই আছে। এর কারণ, কারিগররা ঠিকই তাদের শিষ্যদের মূল রেসিপিটা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।"
ছোটবেলা থেকে এই রেস্তোরাঁয় খেতে আসছেন মোস্তফা জাকওয়ান। পাশেই বাংলাবাজারে তাদের রয়েছে প্রকাশনী সংস্থা। জাকওয়ান বলেন, "এটি আমাদের পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট। এখানে খাবারের যেসব আইটেম পাওয়া যায়, তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না বা গেলেও একই স্বাদ মিলবে না। এখানকার ক্রাম চাপ, চিংড়ি চাপ একেবারেই অনন্য।"
বর্তমানে ক্রামচাপের স্বাদ নিতে আপনাকে গুনতে হবে ১৫০ টাকা। ফলে খাবারের দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে কিঞ্চিৎ অসন্তোষ রয়েছে। সেটি স্বীকার করে নিয়ে জাকওয়ান বললেন, "যেভাবে প্রতিদিন সবকিছুর দাম বেড়ে চলেছে, তাতে এখানেও যে খাবারের দাম বৃদ্ধি পাবে, সে তো স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ক্রেতা বা বিক্রেতা কারোর হাতেই কিছু নেই।"
"তবে এখানকার খাবারের স্বাদের কাছে দামের পার্থক্যটা বড় কিছু না", হাসিমুখে বলে উঠলেন পুরনো ঢাকার স্থানীয় এই বাসিন্দা।
১৯৬৫ সালে হরিপদ ঘোষ 'ক্যাফে কর্ণার' শুরু করেন। ২৭ বছর পর, '৯২তে এর মালিকানা আসে সোলায়মান মল্লিকের হাতে। হরিপদ এরপর কোলকাতায় চলে যান বলে শোনা যায়।
ছোট এ খাবারের দোকানটির প্রধান আকর্ষণ ক্রাম চাপ। এই চাপের মূল উপকরণ খাসির মাংস।
ক্রাম চাপের স্বাদ যে একবার পেয়েছে, তাকে বারবার ক্যাফে কর্ণারে আসতেই হবে! অনিল মিত্র তাই জানালেন, এখানে যারা খেতে আসেন, তাদের প্রায় সবাই পুরনো গ্রাহক।
সকাল ৭টা শুরু করে সপ্তাহের প্রতিদিনই রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে ক্যাফে কর্ণার। সকালে থাকে নাস্তার আইটেম, তবে বিকিকিনি জমে ওঠে সন্ধ্যার দিকে।
কথা হলো ক্যাফে কর্ণারের বর্তমান প্রধান বাবুর্চি মো. মহসিনের সাথে। আগের সবাই ছিলেন খ্রিস্টান। মহসিনের হাত ধরে প্রথম কোন মুসলমান বাবুর্চির হাতে ক্যাফে কর্ণারের নেতৃত্ব আসে।
তার কাছ থেকে জানা গেল, বিপুল জনপ্রিয় এই ক্রাম চাপের মূল রেসিপি ছিল জোসেফ বাবুর্চির। তিনি ছিলেন হাড়িখোলার বাসিন্দা। পাকিস্তান আমলে তার হাত ধরেই ক্যাফে কর্ণারের উদ্বোধন। তারপর কিছুদিন হেঁশেল সামলান জোসেফের ছেলে অজিত। এরপরে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব নেন পিটার ও জন গোমেজ। 'ওস্তাদ জন' ছেড়ে যাবার আগে দায়িত্ব অর্পণ করেন মহসিনের হাতে।
মহসিনের ভাষায়, "এই ক্রাম চাপ দেশে তো নয়ই, বিদেশেও কোথাও মিলবেনা। আমাদের অনেক পুরনো কাস্টমার আছেন, যারা বিদেশে চলে গেছেন। তারা দেশে এলেই, আমাদের দোকানে খেতে চলে আসেন। অনেক সময় বিদেশে নিয়েও যান সাথে করে।"
"একসময় খাসির মাংস ছিল ৬০ টাকা কেজি। তখন এ দোকানে ক্রাম চাপ বিক্রি হতো মাত্র ১৩ টাকায়। আর এখন খাসির মাংস ১০০০-১১০০ টাকা কেজি। ফলে মান ও স্বাদ ধরে রাখতে আমাদেরও বাড়াতে হয়েছে খাবারের দাম।"
"তাছাড়া আমরা যখন আসি তখন এই দোকানে এক টাকা করে লুচি-পরোটা বিক্রি হতো। তখন এসব ভাজা হতো ঘি দিয়ে, এরপর পাকোয়ান ডালডা। সেই লুচি-পরোটা এখনো আছে, তবে এখন রান্না হয় সয়াবিন আর পাম অয়েলে। এভাবেই চলছে…" বলতে বলতে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার।
"তবু কয়েক দশক ধরে পুরনো ঢাকাবাসীর কাছে ভীষণ পছন্দের এই রেস্তোরাঁ। ক্যাফে কর্ণারের জনপ্রিয়তা এখনও একই আছে। ওয়ারি, বনানী, ধানমন্ডি- ঢাকার সব প্রান্ত থেকেই লোকজনকে আসতে দেখি,' মহসিন যোগ করেন।
৩২ বছর ধরে রেস্তোরাঁর প্রধান দায়িত্বে থাকা মহসিনের সঙ্গে এসব গল্প করতে করতে যেন আমরাও চলে গেছিলাম সেই পুরোনো দিনগুলোতে। তিনি বলতে শুরু করলেন, 'একসময় ক্যাফে কর্ণারে পা পড়েছে সাহিত্য, রাজনীতি ও বিনোদন জগতের বিখ্যাত অনেক মানুষের। ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মৌসুমী ও সালমান শাহ অভিনীত বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' এর মহরত অনুষ্ঠানে প্রায় ৩০০ লোকের আয়োজনে ছিল ক্যাফে কর্ণারের আইটেমও। ক্যাফে কর্ণারের প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ সম্পর্কেও তার কাছ থেকে জানা গেল আরও তথ্য। হোটেল ব্যবসায়ী ছিলেন হরিপদ, 'হ্যাপি সুইট মিট' নামে এখানেই ছিল তার মিষ্টির দোকান।
জিভে আনা বিখ্যাত এই ক্রাম চাপের রেসিপি জানতে চাইলে মহসিন জানান, "খাসির মাংসের কিমা করে তেল আর বিস্কুটের গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে ডুবোতেলে মুচমুচে করে ভাজা হয়। তারপর লালচে বাদামি হয়ে গেলে নামিয়ে ফেলা হয়।"
তারপর মজা করে খানিকটা দম্ভের সঙ্গেই বললেন, "কীভাবে বানাই তা নিজ চক্ষে দেখে গেলেও কেউ এটা বানাতে পারবেনা। কারণ এটা হলো এত বছরের অভিজ্ঞতার ফসল।"
পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের এক কোণে নিজস্ব ঐতিহ্য-ইতিহাস নিয়ে ৫৬ বছর ধরে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাফে কর্ণার। এখানকার ক্রাম চাপের জনপ্রিয়তা এতই যে, যে একবার খেয়েছে সেও চাপ দেখেই বলে দিতে পারবে, এটি সেই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ক্রাম চাপ। স্বাদ তো বটেই, এর আকৃতি, রং, গন্ধ এবং পরিবেশন আপনাকে একটু ব্যতিক্রমী স্বাদ দিতে বাধ্য। রসনাবিলাসীদের জন্য ক্যাফে কর্ণার এক আবেগের নাম।