ভবিষ্যতে কর্মজীবন ৪০ থেকে বেড়ে হবে ৬০ বছর
স্ট্যানফোর্ড সেন্টারের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, আজ যে শিশুর ৫ বছর, সে শতবর্ষ আয়ু লাভের আশা করতে পারে।
১০০ বছর বেঁচে থাকলে আমাদের কাজ করতে হবে ৬০ বছর বা তারও বেশি।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্র থেকে গড় অবসর নেওয়ার বয়স ৬০। ২৫ বছর বয়সে কেউ কর্মজীবনে ঢুকলে তাকে কাজ করতে হয় ৩৫ বছর।
কিন্তু ১০০ বছর বাঁচলে, আমাদের আরও বাড়তি প্রায় ২০ বছর কাজ করতে হবে। এই খবরে আতঙ্কিত হয়ে উঠতে পারেন অনেকেই।
আমেরিকায় অবসর নেওয়ার গড় বয়স ৬২। সিংহভাগ আমেরিকানের মতে, ৪০ বছর বা তার কিছু বেশি সময় কাজ করাই যথেষ্ট। সুতরাং, বাড়তি ২০ বছর কাজ করা সবার জন্যই ভীষণ বিরক্তিকর ও হতাশাজনক খবর।
তাছাড়া এখনই কর্মজীবনে প্রবেশের পরপরই বিয়ে, সন্তান-সন্ততি প্রভৃতি দায়িত্ব এসে চাপে আমাদের কাঁধে। নিতে হয় বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদের দায়িত্বও। কাজ ও পরিবারের দায়িত্ব দুটোই সর্বোচ্চ থাকে মধ্যবয়সে। এর ফলে মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ওঠে সবাই। কাজেই বাড়তি বিশ বছর কাজ করার উদ্যম রাখার জন্য কাজের পদ্ধতি থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ পর্যন্ত প্রায় সবই নতুন করে সাজাতে হবে।
বর্তমান মডেল অনুসারে, মানুষ যখন কর্মজীবনে থাকে তখন তাকে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আবার অবসর নেওয়ার পর জীবন একেবারেই কর্মহীন হয়ে যায়। মানুষের আয়ু বাড়লে তাকে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিতে হবে প্রায় ৮০ বছর বয়সে।
বর্তমান মডেলেই কাজ করতে হলে তখন মানুষকে দীর্ঘ কর্মজীবনে কাজ করতে হবে অস্বাভাবিক বেশি। আবার অবসর নেওয়ার পরও দীর্ঘসময় তাকে সম্পূর্ণ কর্মহীন থাকতে হবে। ফলে কর্মজীবন যেমন দীর্ঘ হবে, তেমনি মানুষের ওপর বাড়বে কাজের বোঝাও।
এ মডেলে কাজ করে মানুষ কর্মক্ষেত্রে খুব সম্ভব তার সেরাটা দিতে পারে না। পার্ডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইলেন আর্নস্ট কোসেক একটি কোম্পানির কর্মীদের পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পর্যবেক্ষণে দেখতে পান, কাজের চাপ কমিয়ে দিলে কর্মীরা আরও বেশি 'সৃজনশীল' ও 'উদ্ভাবনী' হয়ে উঠছে। এর কারণ, চাপের মধ্যে কাজ করলে কর্মীরা পরিবার ও প্রিয়জনদের ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। এর ফলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় তাদের ওপর, যার প্রভাব পড়ে তাদের কাজের পারফরম্যান্সে।
এই সমস্যার সমাধানে কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মঘণ্টা বিভিন্ন অনুপাতে বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, কোনো দম্পতির সন্তান যখন ছোট থাকে; তখন তাদেরকে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পূর্ণকালীন চাকরির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সন্তান বড় হয়ে গেলে পরবর্তীতে তারা বেশি কাজ করে এই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারবেন।
যৌবনে আমরা এমনিতেই বেশি পরিশ্রম করি। এ সময় পরিবার-বন্ধুদের সময় দেওয়া হয় কম। জীবনের এই পর্যায়ে যদি মানুষকে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয়, তাদের নিজস্ব শখের কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তাদের ওপর চাপ অনেকাংশেই কমবে। এতে বাড়বে তাদের কাজের উৎপাদনশীলতা।
এই মডেলের আওতায় লোকে এখন যে পরিমাণ কাজ করে সেই একই পরিমাণ কাজ করবে। তবে জীবনের একেক পর্যায়ে তাদের কর্মঘণ্টার মেয়াদ হবে একেক রকম।
এখনই অনেক প্রতিষ্ঠান এ রকম মডেলের প্রয়োগ করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের আরও সৃজনশীল করে তোলার জন্য সাপ্তাহিক ছুটি তিন দিন করে দিচ্ছে। এমনকি কর্মীদের ওপর মানসিক চাপ কমানোর জন্য একটি দেশ রীতিমতো আইন করে অফিসের সময়ের বাইরে অফিসের পক্ষ থেকে কর্মীদের ফোন বা ইমেইলসহ যেকোনো ধরনের যোগাযোগ করা নিষিদ্ধ করেছে।
তবে এই মডেলের কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন কর্মীদের প্রশিক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু কর্মীদের কর্মঘণ্টা কমে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের অনুপাতে ফলাফল কম পাবে। তাছাড়া কর্মীরা যদি লম্বা ছুটিতে যায়, তাহলে ফিরে এসে নতুন প্রযুক্তি ও অফিস-প্র্যাক্টিসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাবে।
মানুষ দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী হলে আরও একটা সমস্যা হলো, কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাদের হাতে অনেক বেশি সময় থেকে যাবে। এর ফলে একসময় কর্মজীবনে যারা ফলপ্রসূ কর্মী ছিলেন, তাদের অবসরজীবন হয়ে উঠবে নিষ্ফলা। এতে অনেকের জীবনই বিষিয়ে উঠতে পারে।
এ সমস্যার সমাধানের জন্য গবেষকরা 'রিটার্নশিপ' নামের একটি উপায় বাতলেছেন। রিটার্নশিপের আওতায় অবসর নেওয়া ব্যক্তিরা মাঝেমধ্যেই অবসর ভেঙে ফিরে এসে কোনো কোনো প্রকল্পে বা তরুণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করবেন।
গবেষকরা বলছেন, কর্মঘণ্টার পরিমাণ কমিয়ে অবসর নেওয়ার বয়স বাড়িয়ে দিয়ে ভালো উপকার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে শেষ বয়স পর্যন্ত অল্পস্বল্প কাজ করে যাওয়াটা ভালো সমাধান হতে পারে।
তাছাড়া আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও দীর্ঘ কর্মজীবন মানুষের জন্য সহনীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন কাজ করা এবং কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনাটা আজকের দিনে অনেকের জন্যই কল্পনা করাটা কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু এখনকার পৃথিবীর অনেক প্রযুক্তি ও রীতিনীতিই আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছেও অকল্পনীয়ই ছিল।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক