রেডিও! আজও না শুনে যারা থাকতে পারেন না
নীলা আক্তার এখন ডাক্তার। ওয়ার্ড ভিজিট করে চেম্বারে এসে যখন রেডিও খুলে বসেন, তার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। রেডিওর সঙ্গে তার প্রেমের শুরু ক্লাস ফোরে থাকতে। বড় ভাই কোনো এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি রেডিও ধার করে এনেছিল।
প্রথম দেখাতেই নীলা সেই রেডিওর প্রেমে পড়ে যান। ভাইয়া যখন ফেরত দিতে যাবে, নীলা বেঁকে বসেন—কিছুতেই ফেরত দিতে দেবেন না। অবশেষে নীলার জেদের কাছে ভাইকে হার মানতে হয়েছিল। বাধ্য হয়ে বন্ধুকে নতুন একটি রেডিও কিনে দিয়েছিল তার ভাই। সেদিন থেকে ভারতীয় সন্তোষ ব্র্যান্ডের রেডিওটি নীলার সঙ্গী।
দিনে দিনে মহানগর, দর্পণ, উত্তর, দুর্বার, গানের ডালি, ঝংকার, সিনেরং, নিবেদন, মধুছন্দা ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো তার প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় এলে কিছুদিন রেডিওটি থেকে দূরে ছিলেন। পরে যখন ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন আবার ফিরে পান 'সন্তোষকে'ও। নীলার জন্য সন্তোষের কাছ থেকে দূরে থাকাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়।
এখনো রেডিও তার নিয়মিত সঙ্গী। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে মন দিয়ে রেডিওর অনুষ্ঠান শোনেন। তার ভাষ্য, 'রেডিও শুনলে বিষাদ দূর হয়ে যায়, নতুন করে এনার্জি ফিরে পাই।' সপ্তাহে বন্ধের দিনে নাওয়া-খাওয়ার বাইরে বাকি সবসময় রেডিওর সঙ্গেই কাটে তার।
নানার দেওয়া রেডিও নাতির কাছে
শাফিন রানার নানাজান তার মেয়ের বিয়েতে জামাইকে একটি রেডিও উপহার দিয়েছিলেন। তখন রেডিও দেখতে লোকে বাড়িতে ভিড় করত। সবার কাছে এটি অত্যাশ্চর্য এক বস্তু ছিল।
শাফিনের নানা বেশ সম্পদশালী ছিলেন। সে আমলের জমিদার বলা যায়। শাফিনের বাবাকে রেডিও উপহার দেওয়ার সামর্থ্য তার ছিল। সন্ধ্যা হলে গ্রামের লোকজন দিনের কাজ শেষে শাফিনদের উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসত। বাবা রেডিও চালিয়ে দিলে শুরু হতো সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান 'দুর্বার'। এরপর রাত সাড়ে আটটায় হতো সংবাদ। সংবাদ শুনে শেষে সবাই যার যার ঘরে ফিরত।
শাফিন রেডিওটাকে নিজের করে পেতেন সবাই উঠে যাওয়ার পর। নয়টা পাঁচ মিনিটে শুরু হতো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'উত্তরণ', যা শাফিনের খুব প্রিয় ছিল। সপ্তাহের যে দিন নাটক ও যাত্রাপালা প্রচার হতো, সেদিনও শাফিনদের বাড়িতে মানুষের ঢল নামত। বিশেষ করে 'গুনাই বিবি' ও 'সিরাজউদ্দৌলা' শুনতে দু-চার গ্রামের সব মানুষ এসে জড়ো হতো বাড়ির আঙিনায়।
ছোটবেলা থেকেই শাফিনের রেডিওর প্রতি ঝোঁক ছিল। তা কিঞ্চিৎও কমেনি; বরং দিন দিন বেড়েছে। শখের বশে স্কুলের উপবৃত্তির টাকা দিয়ে শাফিন প্রথম নিজে একটি দেশ রেডিও কেনেন। এটি ছিল বাংলাদেশে তৈরি জামান কোম্পানির রেডিও। দাম সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় দেশ রেডিও খুব জনপ্রিয় ছিল।
দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই রেডিও শুনতেন তিনি। ব্যাপারটা এমন, রেডিওই ছিল তার 'প্রেমিকা', যাকে ছাড়া তার চলত না।
এসব নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাফিন রানা লিখেছেন, 'রেডিও শুনে আমি আমার জীবনকে পরিবর্তন করতে পেরেছি। গানের চর্চা, সাধারণ জ্ঞানের চর্চা, শিক্ষামূলক যত কিছু সবই শিখেছি রেডিও থেকে। কোনো ক্লাসে সেকেন্ড হইনি কখনো। এর পেছনেও রেডিওর অবদান ছিল অপরিসীম।'
বিজ্ঞাপন তরঙ্গ না শুনে থাকতে পারতেন না
মেহেদী হাসানের কথা বলা যাক এবার। সরকারের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তাকে একসময় বন্ধুরা ডাকত 'রেডিও মেহেদী' বলে। তার কাছে রেডিও কেবল স্মৃতি নয়, আবেগের নাম। তার বাবা একটি তাঁত মিলে কাজ করতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মেহেদী সবার ছোট। বাড়িতে তাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল একটি সনি রেডিও।
স্কুল থেকে ফিরে যতটা সময় পেতেন, মেহেদী রেডিও শুনতেন। বিকেলে গমের ক্ষেতে পায়রা বা কবুতর তাড়াতে মাঠে গেলেও রেডিও নিয়ে যেতেন সঙ্গে। ক্ষেতের আইলে বসে ছন্দে ছন্দে পড়তেন আর রেডিও শুনতেন।
তখন মেহেদী হাইস্কুলের ছাত্র। একদিন খেয়াল করলেন, তার প্রিয় রেডিওটি বয়সের ভারে নাজুক হয়ে গেছে। কিন্তু রেডিও ছাড়ার মানুষ ছিলেন না তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সেই টাকা দিয়ে কিনেছিলেন একটি ন্যাশনাল রেডিও। ভালোই চলছিল দিন।
স্কুল শেষ হলে ফরিদপুর শহরে কলেজে ভর্তি হলেন মেহেদী। কিন্তু বড়রা তাকে রেডিও সঙ্গে নিতে দিল না, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে। কিন্তু রেডিও ছাড়া থাকা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তাই কিছুদিন পরেই কিনে নেন একটি কেসিবো পকেট রেডিও।
মেহেদী ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলেন, তাই বসতে হতো ফার্স্ট বেঞ্চে। ফলে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু দুপুরে বিজ্ঞাপন তরঙ্গের অনুষ্ঠান শুনতে তার মন আনচান করত।
সে সময়ে তিনি নিয়মিত রেডিওতে চিঠি লিখতেন এবং কুইজে পুরস্কারও জিততেন। একদিন ক্লাসে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেডিও শুনছিলেন। যখনই অনুষ্ঠানে বিজয়ী হিসাবে তার নাম ঘোষণা হলো, তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। স্যারসহ সবাই হেসে উঠেছিলেন সেদিন।
পরের ঘটনাটি বিসিএস ভাইভা পরীক্ষার দিনের। মেহেদী হাসানের প্রথম পছন্দ ছিল তথ্য ক্যাডার। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো কেন তথ্য প্রথম পছন্দ, তখন তিনি গুছিয়ে তার পুরো রেডিও-জীবনের গল্প বলেছিলেন।
বিসিএস অধিকর্তাদেরও কেউ কেউ তার গল্প শুনে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছিলেন।
রেডিওপ্রেমীদের আড্ডাখানা
এখনো অনেকের চোখে পুরোনো সেই রেডিওর ছবিখানাই ভেসে ওঠে। কেউ কেউ পুরোনো এই যন্ত্রটি দেখলে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তাই সন্ধান চালিয়ে যান, কোথায় গেলে আগেকার রেডিও পাওয়া যাবে। অনেকেই খুঁজে পেয়ে ক্রয় করেন তাদের প্রিয় পুরোনো মডেলের রেডিও।
ফেসবুকে 'পুরাতন রেডিও ক্রয়-বিক্রয়' নামে একটি গ্রুপ আছে। এ গ্রুপের সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। এখানে রেডিওপ্রেমী ছাড়া কেউ যোগ দেয় না, আর অ্যাডমিনও সতর্ক থাকেন অনাবশ্যক সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে।
বলা যায়, দেশে এখনো অন্তত ১৮ হাজার রেডিওপ্রেমী আছেন, যারা রেডিও বিনিময় করেন, অনুষ্ঠান নিয়ে মতামত দেন এবং বেতারের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেন।
উপরের ঘটনাগুলোও এই গ্রুপ থেকেই জানা। গ্রুপটি 'রেডিও কীভাবে আপনার জীবনকে প্রভাবিত করেছে' শীর্ষক একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। শতাধিক স্মৃতিচারণ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ৪৫টি বেছে নেওয়া হয়েছে প্রাথমিকভাবে।
প্রতিযোগিতার ভাবনাটি প্রথম আসে গ্রুপের অ্যাডমিন জিয়াউল হাসান সবুজের মাথায়। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছ থেকে তিনটি রেডিও উপহার পাবার পর এই উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যে দুটি দিয়েছিলেন খুলনা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ, আর ১টি ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেটের এক দোকানদার।
সবুজ তখন ভাবেন, একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করে রেডিওগুলো বিজয়ীদের উপহার দেওয়া যায়। সে অনুযায়ী আয়োজিত হয় প্রতিযোগিতাটি, এবং এখন চলছে সেরা রচনা নির্বাচনের কাজ।
গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষি বিভাগের এক কর্মকর্তা, মনিরুল ইসলাম। শুরুতে সদস্যসংখ্যা কম ছিল। মনিরুল খেয়াল রাখতেন, কে বেশি পোস্ট দেয়, সঠিক তথ্য জোগান দেয়, রেডিও বিনিময় করে।
জিয়াউল হাসান সবুজ ছিলেন 'টপ কন্ট্রিবিউটর'দের একজন। তিনি সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকতেন; সাধ্যমতো সদস্যদের প্রশ্নের জবাব দিতেন, রেডিওর ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানাতেন।
মনিরুল ইসলাম যখন সবুজকে অ্যাডমিন হওয়ার আমন্ত্রণ জানান, তিনি রাজি হন। তারপর থেকে গ্রুপটি সবুজই দেখভাল করছেন। সবুজ চাইতেন এটি হয়ে উঠুক রেডিওপ্রেমীদের আড্ডাখানা। সে উদ্দেশ্য অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে। দেশে রেডিওপ্রেমীদের এত বড় প্ল্যাটফর্ম আর নেই।
সবুজ নিজে ৫০টি পুরোনো রেডিও চাহিদামতো পৌঁছে দিয়েছেন।
সবুজের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কোন এলাকায় রেডিও শ্রোতা বেশি। তিনি বলেন, 'উত্তরাঞ্চলে, যেমন রংপুর, নওগাঁ, দিনাজপুর, নাটোর, রাজশাহীতে রেডিও শ্রোতা বেশি। ঐসব অঞ্চলের দুর্গম চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট নেই। তারচেয়েও বড় কথা, ঐতিহ্যগতভাবেই সেই এলাকার মানুষ রেডিওর সঙ্গে সংযুক্ত।
'এরপর আসে উপকূলীয় অঞ্চল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর জানার মাধ্যম হিসেবে রেডিও এখানে খুবই প্রয়োজনীয়। সাগরগামী জেলেদের জন্য রেডিও রাখা বাধ্যতামূলক, না হলে নৌবাহিনীর ছাড়পত্র মেলে না।'
সবুজ আরও জানান, একসময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সৈনিকদের রেডিও দেওয়া হতো। জিয়াউর রহমানের আমলে গ্রামের লোকদের ফ্রি রেডিও বিলি করা হতো। আশির দশকে মারফি, সনি, ন্যাশনাল, ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও সেট পাওয়া যেত।
তখন এসব রেডিওর দাম ছিল ২০০, ২২৫, বা ২৫০ টাকা। ফিলিপস রেডিওরও চাহিদা ছিল, যা দেশেই তৈরি হতো এবং এর দাম গায়ে খোদাই করে লেখা থাকত। সবুজ একটি ফিলিপস রেডিও দেখেছিলেন, যার দাম ছিল ৬৫০ টাকা। এটি তখন বেশ দামী রেডিও হিসেবে ধরা হতো, এবং মানও ছিল উন্নত।
রেডিওর আনন্দ রেডিওতেই
আজকে যখন টেলিভিশন ঘরে ঘরে, মোবাইল ফোন হাতে হাতে, তখনো রেডিও কতটা গুরুত্ব রাখে? প্রশ্নের উত্তরে সবুজ বলেন, 'দেখুন টেলিভিশন দেখতে দেখতে আপনি অন্য কাজ করতে পারবেন না। অথচ রেডিও চালিয়ে রেখে আপনি খাবার খেয়ে নিতে পারেন, রান্না সারতে পারেন, জমিতে আগাছা পরিস্কার করতে পারেন। অন্যদিকে মোবাইল ফোনে প্রচুর নোটিফিকেশন আসে। কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তখন ফোন চলে এলো। তাই মোবাইলেও রেডিও শুনে আনন্দ হয় না। যারা রেডিওপ্রেমী তারা রেডিও সেটেই শোনে। নব ঘোরানোরও একটা আনন্দ আছে।'
সবুজের মতে, সময়ের চাহিদা পূরণে রেডিওর বিকল্প হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ-বিদেশ—সবকিছুই ধারণ করতে পারে রেডিও। সাথে সবরকম মানুষের চাহিদাও পূরণ করতে পারে।
সাতচল্লিশ বছর বয়সি সবুজ পেশায় একজন শিক্ষক। রেডিও তার পেশাগত কাজেও সাহায্য করে। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের মতো বিশেষ দিনে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে কিছু বলার প্রয়োজনও পড়ে মাঝেসাঝে।
সকালে দাড়ি কামাতে কামাতে রেডিওতে বিশেষ দিবসের কথিকা শুনে নিলে তার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সকালে জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকগুলোর শিরোনাম ও সংবাদ নিয়ে যে অনুষ্ঠান হয় তা শুনলে দেশ-বিদেশের অনেক খবরই জানা হয়ে যায়।
খুলনার আঞ্চলিক অনুষ্ঠান বেশি শোনেন
১৯৮৭ সালে সবুজ পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। বৃত্তির ৩৫০ টাকা হাতে পান ১৯৮৮ সালে। টাকাটা তাকে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করার অনুমতি দেয় পরিবার। তাদের বাড়ি থেকে ১০ মাইল দূরে পিরোজপুরের শ্রীরামকাঠি বন্দর।
বৃত্তির টাকা নিয়ে সে বন্দরে যায় সবুজ। ঘুরতে ঘুরতে রেডিওর এক দোকান তিনি দেখতে পান। কৌতূহলী হয়ে একটি রেডিও হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেন। সেটি ছিল এক ব্যাটারির পার্ল রিভার রেডিও। ঐ রেডিও কিনে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন সবুজ।
প্রথমদিকে তার পছন্দের অনুষ্ঠান ছিল ১০ মিনিটের সিনেমা বিজ্ঞাপন। পরে জানতে পারে চিঠিপত্র দেওয়ারও সুযোগ আছে। টেবিলেই চলতে থাকতো রেডিওটি, সবুজ পড়তে থাকতেন।
এভাবে দিন গেছে আর রেডিওর সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছে। কর্মজীবনেও তার ছেদ ঘটেনি। বাড়ি তার বাগেরহাট। তাই খুলনার আঞ্চলিক বেতার বেশি শোনার সুযোগ হয়। খুলনা বেতারের আঞ্চলিক নাটক তার খুব পছন্দ। খুলনা অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানও শোনেন মন দিয়ে।
বিবিসি যখন চালু ছিল নিয়মিত শুনতেন। সাথে ডয়চে ভেলে আর ভয়েস অব আমেরিকাও শুনতেন। এখন কলকাতার আকাশবাণী মৈত্রীর সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি তিনি নিয়মিত শোনেন।
বিদ্যুৎ না থাকলেই রেডিও শুনতে বেশি মজা বলে জানালেন সবুজ। কারণ তখন আশপাশের অনেক শব্দই কমে যায়। নিঝুম-নিরলে রেডিও শোনার মতো আনন্দ আর কিছুতেই পাওয়া যায় না।
প্রখ্যাত রেডিও শ্রোতাদের মধ্যে কচুয়া বাগেরহাটের তুষার রায় রনীর সঙ্গে তার আলাপ আছে। কুষ্টিয়া ভেড়ামারার সদ্য প্রয়াত মোখলেসুর রহমানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল তার।
নামে চেনেন মাগুরার আমজাদ হোসেনকে, রাজবাড়ি শ্রোতাদলের গোপীনাথ রায়, শাহীন আলী প্রমুখকে।
সিডরের দিন যা ঘটেছিল
সিডরের সময় রেডিওর সতর্কবার্তায় আস্থা রেখেছিলেন বলেই সবুজ ও তার পরিবার নিরাপদ থাকতে পেরেছিলেন। সেদিন (১১ নভেম্বর, ২০০৭) সকাল থেকেই রেডিওতে ১০ নম্বর বিপদসংকেত দেওয়া হচ্ছিল। যদিও আকাশ ছিল একদম পরিস্কার। এমনকি বিকেলের আকাশও ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস দেয়নি। অথচ রেডিওতে বিরামহীনভাবে প্রবল ঝড়ের কথা বলা হচ্ছিল।
সন্ধ্যার অল্প পরে সবুজ তার ছোট বাচ্চা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এক আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গিয়েছিলেন। যেতে যেতে সতর্ক করেছিলেন আশপাশের সবাইকে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। অল্পজনই তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তারা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছানোর কিছু পরে ঝড় প্রবলবেগে আছড়ে পড়ে আর ঘরবাড়ি সব মুহুর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
সবুজ আক্ষেপ করছিলেন, 'পরদিন যখন চেনা মানুষগুলোর হদিস পাচ্ছিলাম না, খুব খারাপ লাগছিল। ভাবছিলাম কেন আরেকটু জোর করলাম না। আসলে আকাশে ঝড়ের চিহ্নই ছিল না। হঠাৎ এমন বেগে আছড়ে পড়বে তা ধারণাও করিনি। রেডিওর সতর্কবার্তায় আস্থা রাখলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা এড়ানো যেত।'
ভেতরে ছোট-ছোট মানুষ কথা বলে
এখনকার প্রজন্ম কি রেডিও শোনে? প্রশ্ন শুনে সবুজ বললেন, 'আমাদের গ্রুপে কিছু সদস্য আছে যাদের বয়স বিশও হয়নি। তারা নিয়মিত অনুষ্ঠান শোনেন, অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনাও করেন।'
তিনি বলেন, তাদের প্রতিযোগিতার ২৭ বছর বয়সি নাজমুল হক লিখেছেন, 'আমার বাসা পাবনা জেলার আতাইকুলা থানায়। রেডিওর সঙ্গে যখন আমার পরিচয় তখন বয়স মাত্র পাঁচ। যন্ত্রটি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের জমিতে কাজ করতেন পড়শি এক চাচা।
'একদিন দুপুরের খাওয়া শেষ করে ব্যাগ থেকে কালো রঙের একটি জিনিস বের করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি, এটা দিয়ে কি করে? উনি রসিক মানুষ ছিলেন। বললেন, এটা হলো জাদুর বাক্স। এর ভিতরে পিপড়ার মতো ছোট ছোট অনেক মানুষ থাকে। তারা গান গায়, গল্প শোনায়। রেডিও অন করার পর শুনলাম ২-৩ জন মানুষ কথা বলছে। তারপর যখনই কাকু রেডিও শুনতো, আমি পাশে গিয়ে বসতাম।'
নাজমুল আরও লিখেছেন, ভেতরের মানুষগুলোকে দেখার তার খুব সাধ জাগল। ' একদিন কাকু বাইরে ছিল, আমি ব্যাগ থেকে রেডিওটা বের করে ভেঙে চুরমার করে ফেলি। কিন্তু মানুষগুলো আর খুঁজে পেলাম না। কাকু রেডিওর কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি কান্না করে দিলাম আর সব কথা বলে দিলাম। কাকু রাগ করেননি, বললেন, তুমি বড় হলে আমাকে একটা রেডিও কিনে দিও।'
দিন কয় আগে সবুজদর গ্রুপের এক সদস্যের কাছ থেকে দেশ ও কেসিবো ব্র্যান্ডের ২টি রেডিও সংগ্রহ করেন নাজমুল। তার একটা রেডিও তিনি উপহার দিয়েছেন ছোটবেলার সে কাকুকে।
"গিয়ে বললাম, 'কাকু, তোমার জন্য জাদুর বাক্স নিয়ে এসেছি, যার মধ্যে পিপড়ার মতো ছোট ছোট মানুষ গল্প করে, গান গায়।' তিনি আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন। সে হাসির মধ্যে ছিল সেই ফেলে আসা অতীত।"
এ আনন্দ ভাগ করা যায় না
এবার সবুজকে শেষ প্রশ্ন: পুরাতন রেডিও সংগ্রহ করার মধ্যে আনন্দ কোথায়? সবুজ বলেন, 'এ আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না। যারা রেডিওপ্রেমী, তাদের কাছে একটা আলাদা ব্র্যান্ডের রেডিও হীরার চেয়ে দামী।'
একবার একটা সন্তোষ রেডিও সংগ্রহের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আশপাশের যে ভারতে যেত, তাকেই বলে একটা এনে দিতে। কিন্তু সেভাবে কেউ রাজি হচ্ছিল না। শেষে ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গের একজনের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব করেন। তাকেই বলে বসেন, একটি সন্তোষ কিনে রাখতে। তিনি রাজি হন।
কিছুদিন পর এলাকার একজন যাচ্ছিলেন ভারতে, তাকে টাকা দিয়ে বলেন, 'আপনি শুধু এই নম্বরে ফোন করবেন, আপনার কাছে এসে পৌছে দিয়ে যাবে।' পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুটি তার কথা রেখেছিলেন। তার এলাকার ভাইটিও কষ্ট করে তা বয়ে এনেছিলেন।
'অনেকে এমনও আছেন, আগ্রহের রেডিওটি সংগ্রহ করতে শেষ টাকাটিও খরচ করে ফেলেন। এ আনন্দ সত্যি বলার মতো নয়, শুধু অনুভব করবার বিষয়', বলেন সবুজ।