মৃতপ্রায় তুরাগ এখনও ঢাকার পণ্য সরবরাহের পথ
আমিনবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বাল্কহেড জাহাজের নাবিক মো. রানা। যেখানে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেখানেই ঢাকার দুটি প্রধান নদী তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা মিলিত হয়েছে। নদীর অপর পাশে গাবতলি ল্যান্ডিং স্টেশন।
শত শ্রমিক বাল্কহেড থেকে সিমেন্টের বস্তা নামাচ্ছিলেন।
রানা বলেন, "আজ আমি ৯ হাজার ব্যাগ [তার হিসাব অনুযায়ী ৪৫০ টন] সিমেন্ট নিয়ে এসেছি। ভেবে দেখুন, এসব ব্যাগ নিয়ে যেতে আপনার কতগুলো ট্রাক লাগবে?"
রানা ঠিকই বলেছিলেন। যদি ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার নদীগুলো না থাকতো, তাহলে শহরটি সরবরাহ চেইনের জন্য একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো। ফলে, শহরের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চলাচল করতে হতো।
শাহ, আকিজ, প্রিমিয়াম, স্ক্যান ও আমানসহ বেশিরভাগ সিমেন্ট কোম্পানির স্টেশন তুরাগ নদীর চারপাশের অন্যান্য এলাকা ছাড়াও এখানে রয়েছে।
রানা বলেন, "আমরা তুরাগ নদীর মাধ্যমে বিভিন্ন ঘাটে পণ্য পরিবহন করি। একসময় আমরা সরাসরি গাজীপুরে যেতাম। কিন্তু সেই চ্যানেল এখন আর নেই। তুরাগ মরে যাচ্ছে।"
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর বর্ষাকালে ভালো প্রবাহ থাকে। তুরাগের পানিও একটি সুস্থ নদীর মতো ভালোভাবে প্রবাহিত হত। কিন্তু বর্তমানে নদীর প্রবাহ শুধু একটি বিভ্রান্তি। এক-দুই মাসের মধ্যে নদীটি একেবারেই কালো পানির নালায় পরিণত হবে।
নদী ও ডেল্টা গবেষণা কেন্দ্রের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, "হাইকোর্ট তুরাগ নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তবে, এই নদীর প্রতি যে আচরণ হচ্ছে, তাতে 'আমরা যৌথভাবে এটি হত্যা করছি' বলাটাও কম বলা হবে।"
তারপরও, নদীটি ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। সিমেন্ট, কয়লা, বালু, সার এবং পাথরের মতো সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রী তুরাগের মাধ্যমে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, আকিজ প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার ব্যাগ সিমেন্ট নিয়ে আসে বলে জানান কোম্পানির স্টেশন ইন-চার্জ ওয়াহেদুজ্জামান।
তিনি বলেন, "এখান থেকে সিমেন্ট ঢাকা শহর, মানিকগঞ্জ এবং অন্যান্য অঞ্চলে যায়।"
শাহ সিমেন্ট প্রতিদিন এই স্টেশন থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ব্যাগ সিমেন্ট [প্রায় ২০০ টন] সরবরাহ করে। প্রিমিয়াম সিমেন্ট তাদের মুন্সিগঞ্জের কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টন সিমেন্ট পরিবহন করে।
একটি 'বহুমুখী' নদীর দুঃখের গল্প
"বুড়িগঙ্গা ঠিক আছে। কিন্তু আশুলিয়া গিয়ে তুরাগকে দেখুন, নদীটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে," আমিনবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা সুলতান টিবিএসকে বলেন।
নদী বিশেষজ্ঞ এজাজ আরও ব্যাখ্যা দিলেন।
তিনি বলেন, "বুড়িগঙ্গার এখন দুটি উদ্দেশ্য আছে: যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন। কিন্তু তুরাগের অনেক বেশি উদ্দেশ্য রয়েছে। তুরাগের তীরে সিমেন্ট কারখানা এবং তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এখানে ব্যাপক শিল্পায়নও হয়েছে। নদী দখল করে আবাসন নির্মাণও করা হয়েছে।"
দখল এবং বর্জ্য জমার কারণে এই নদী বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ, শিল্প ও বাসিন্দারা নদীকে একটি ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে।
গাবতলী, নবাবেরবাগ, বিসিল, মিরপুরসহ অনেক স্থানে নদীটি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৯ সালে হাইকোর্ট থেকে "আইনি ব্যক্তি" মর্যাদা পাওয়ার পরও তুরাগের জন্য পরবর্তী বছরগুলো ভালো যায়নি।
কারখানাগুলো নদীতে এবং গাজীপুরের আশেপাশের খাল ও জলাভূমিতে বিষাক্ত তরল বর্জ্য ফেলে যাচ্ছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ রিভার ট্র্যাভেলারের নেটওয়ার্ক ৯৬টি স্থান চিহ্নিত করেছে, যেখানে বর্জ্য টঙ্গী থেকে শুরু করে ঢাকার কোড্ডা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত তুরাগ নদীর ৪০ কিলোমিটার অংশকে দূষিত করছে।
ক্ষতবিক্ষত, তবুও বেঁচে আছে
পালক ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মাশরুক নদীর তীরে কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
তিনি জানান, এখান থেকে কয়লা উত্তরবঙ্গ, মানিকগঞ্জ, আরিচা, টাঙ্গাইল এবং অন্যান্য অনেক জায়গায় যায় এবং ইটভাটা ও ব্যাটারি কারখানার বয়লারগুলোতে ব্যবহার করা হয়।
মাশরুক জানান, তিনি সরাসরি দেখেছেন কীভাবে তার ব্যবসার সরবরাহ চেইনের মূল স্তম্ভ তুরাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "নদীতে চিহ্নিত এলাকা রয়েছে। কিন্তু মানুষ সেটা মানে না। অনেকেই কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এসব এলাকা দখল করছে। এখন পানি পরিষ্কার, কিন্তু তিন মাস পর আসুন, পানির রং হবে কালো এবং দুর্গন্ধে ভরা।"
শাহারা এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ মোহসিন জানান, তারা গত বছর প্রায় দুই লাখ টন কয়লা নিয়ে এসেছে।
"শুকনো মৌসুমে আমাদের জাহাজ নেভিগেট করতে খুব কষ্ট হয়," মোহসিন বলেন। তিনি আরও বলেন, "নদী ছাড়া এখানে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এই পরিমাণ পণ্য ট্রাকে পরিবহন করা অসম্ভব। আমরা ১ লাখ থেকে ২ লাখ টনের কথা বলছি। সড়ক দিয়ে এই পরিমাণ পণ্য স্থানান্তর করতে কত বছর লাগবে বলে আপনার মনে হয়? এবং এটা শুধু আমি না, এখানে অন্যান্য কোম্পানিও একই পরিমাণ কয়লা, বালু, সার ইত্যাদি স্থানান্তর করে।"
মোহসিন বলেন, "যদি আমি ২ লাখ টন নিয়ে আসি, অন্যরাও একই কাজ করছে। এত পরিমাণ পণ্য ট্রাকে নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। আমাদের নদীগুলো আমাদের জীবন।"
গাবতলীতে নদীর দুই পাশে প্রায় সমান সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শত শত শ্রমিক পাথর, কয়লা, বালু ইত্যাদি নামাচ্ছিলেন।
এক গরম দুপুরের স্নিগ্ধ বাতাসে সেখানের একটি ল্যান্ডিং স্টেশনের কর্মী আল আমিন বলেন, "দুর্গন্ধের জন্য কিছু মাস পর এখানে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।"
নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা
আরডিআরসির মোহাম্মদ এজাজ বলেন, তুরাগ নদীর বৃহত্তম বাস্তুতন্ত্র হচ্ছে এর জলাভূমি। কিন্তু এগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান, তুরাগের তীরে ৬৯টি মাছ ধরার গ্রামের জনগণ দূষণের কারণে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে কারণ তারা আট মাস বেকার ছিল।
এজাজ বলেন, "রিজওয়ানা আপা [পরিবেশ উপদেষ্টা] বলেছেন, বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে। কিন্তু আমি মনে করি তুরাগ পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন। এবং তুরাগ পুনরুদ্ধার করা না হলে, বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "যেহেতু তুরাগকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে, এই বিষয়টি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে, আমি মনে করি কেউ এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়। ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলোর মধ্যে সরকার শীতলক্ষ্যাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তুরাগের ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।"
এজাজ উল্লেখ করেন, "এর বৈশ্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় এবং পশ্চিম ঢাকার উন্নয়নের জন্য তুরাগের গুরুত্ব চিন্তা করে, এটিকে অগ্রাধিকারের জায়গায় রাখা উচিত।"