প্রীতিলতা, নভেরাদের স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক ডা. খাস্তগীর স্কুল: নারী শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা
প্রথম যেদিন রাস্তার পাশের ঐ সাদা-ধূসর বিল্ডিং দেখিয়ে মিনা আমাকে বলেছিল, 'এটা প্রীতিলতার স্কুল' – সেদিন ভালো করে একটু স্কুলটাকে চেয়েও দেখার ফুসরত মেলেনি। সিএনজির টানে স্কুলের প্রাচীরটুকুই কেবল চোখে পড়েছিল। কি উঁচু প্রাচীর স্কুলটার! কিন্তু না দেখলেও– প্রীতিলতার স্কুল শুনেই স্কুলটার প্রতি কেমন মায়া জন্মে যায়। জন্মাতে থাকে কেমন একটা কৌতুহলবোধও। প্রীতিলতার স্কুল! এখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার; এই মাঠে হেঁটে বেড়িয়েছেন, এই ক্লাসরুমগুলোতে বসেই ক্লাস করেছেন!
মালেকা বেগম রচিত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বইটিতে একবার পড়েছিলাম, সাত বছর বয়সে। ডা. খাস্তগীর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রীতিলতা। তৃতীয় শ্রেণি থেকেই নাকি প্রীতিলতার ফলাফল ছিল প্রথম তিনজনের মধ্যে। ম্যাট্রিকুলেশন টেস্ট পরীক্ষাতেও হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রথম। তাই এখানকার শিক্ষকদেরও স্নেহের পাত্রী ছিলেন তিনি।
সেই শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষা দি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই এর ইংরেজ সেনাদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। ঊষা দির দেওয়া "ঝাঁসীর রাণী" বইটি পড়ার সময়ই নাকি ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
চট্টগ্রাম নগরীর জামাল খান সড়কে অবস্থিত
প্রীতিলতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত। হ্যাঁ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তর কথাই বলছি। তিনিও ছিলেন এই স্কুলের ছাত্রী। প্রীতিলতার বন্ধু, তবে বয়সে দুয়েক বছরের ছোট ছিলেন তিনি। দুজন একসাথে ব্যাডমিন্টন খেলতেন খাস্তগীরের এই মাঠেই। পরবর্তীকালে কল্পনা দত্ত তার বইয়ে লিখেছিলেন-'কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানি আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।"
এই দুই সংগ্রামী নারীই নয়, বাংলা সাহিত্যে স্বনামখ্যাত বিদূষী লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী, অধ্যাপিকা শিপ্রা দত্ত, ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শোভনা ধর, গবেষক ও সমাজকর্মী জওশন আরা, শিক্ষাবিদ বদরুন নাহার, সুকন্ঠী রাজিয়া শাহিদ, শিক্ষাব্রতী প্রণতি সেনসহ অনেক কৃতবিদ্য মহিলা এ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এমনকি বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও লেখক ফরিদা আখতারও – এই স্কুলের একজন প্রাক্তন ছাত্রী। এত ঐতিহ্যবাহী একটি স্কুল, খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কী আছে ঐ উঁচু প্রাচীরের ওপাশটায়?
সাদা ধূসর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ভবন
আগেই বলি, চট্টগ্রাম নগরীর জামাল খান সড়কে অবস্থিত এই স্কুলটিকে বাহির থেকে দেখতে কিন্তু ঠিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা স্কুল বলে মনে হয় না। বরং কেমন গা ছমছমে এক অনুভূতি দেয়। যেন শিল্পসংস্কৃতি-তারুণ্যের ছোঁয়া লাগা, এই চিরযৌবনা জামাল খানের বুকে দাঁড়িয়ে— গম্ভীর মুখে সব অবলোকন করছে শতবর্ষী পুরোনো এই স্কুলটি।
গেট দিয়ে একদিন ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একটা সাদা দোতালা ভবন, যার সামনে পেছনে পুরো ভবন জুড়েই টানা বারান্দা। ডানদিকে একটু দূরে আরেকটি দোতালা ভবন। তবে উচ্চতায় এটি প্রথমটির তুলনায় ছোট। হয়তো প্রথমটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বলেই উচ্চতা বেশি। বিশাল বড় স্কুল প্রাঙ্গণ। একাডেমিক ভবন সংখ্যা মোট পাঁচটি। একেক ভবনে একেক শ্রেণির এবং বিভাগের ক্লাস নেওয়া হয়। যদিও, রাস্তা দিয়ে কেবল ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সাদা ধূসর ভবনটিই দেখা যায়।
বাকিগুলো তৈরি হয়েছে কোনটা পাকিস্তান আমলে, কোনটা স্বাধীনতার পরে, কোনটা আবার আশির দশকে। ১৯০৭ সালে যখন স্কুলটি যাত্রা শুরু করে, তখন কেবল উঁচু ব্রিটিশ আমলে তৈরি ভবনটিই ছিল। গেট দিয়ে ঢুকতেই ডানে যে ভবনটি, সেটি পাকিস্তান আমলেই নির্মিত বলে জানান, স্কুলটির দিবা বিভাগের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা কাউসার ফেরদৌস। এরপর আস্তে আস্তে হয়েছে অন্য ভবনগুলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজার মেয়েরাও আসত এখানে পড়তে
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত দোতালা এই ভবনের নিচে ছিল শ্রেণিকক্ষ, অফিস, শিক্ষক-প্রধান শিক্ষকের কামরা। স্কুলটি ছিল দক্ষিণমুখো। সামনে মনোরম ফুলের বাগান। দেশী, বিলাতি নাম না জানা হরেকরকম ফুল। স্কুলের গেটের কাছে দারোয়ানের ঘরের পাশে না-কি একটা শেফালী ফুলের গাছ ছিল। শরৎকাল এলেই, সে গাছের তলাটি ছেয়ে যেত সাদা কমলা শেফালী ফুলে। আর ছড়াতো সুবাস…
খাস্তগীর স্কুলের বাগানের গল্প এখানকার প্রাক্তন ছাত্রীদের থেকে আগেও শুনেছি। তাদের বয়স এখন ষাট সত্তরের কোঠায়। আবার, এক প্রাক্তন ছাত্রীর স্মৃতিকথা থেকে জেনেছি, এখানে নাকি পদ্মফুলও জন্মাতো! সেক্ষেত্রে কোনো পুকুর বা খালের মতো কিছুও থাকার কথা। আরও জেনেছি, গেট দিয়ে ঢুকলে দু ধারেই ছিল ফুলের বাগান। ছিল বকুল ফুল, বড়ই, জল্পাই, বিলম্ব– আরও কত কি।
দুই ধারের বাগানের মধ্যখান দিয়ে গেট থেকে সোজা চলে গেছে পিচ-ঢালা একটি রাস্তা। ভবনটির মাঝবরাবর গিয়ে পোর্টিকোর মত বড় খিলান দেওয়া এক প্রবেশপথ। প্রবেশপথের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে দু পাশে লম্বা বারান্দা। যেখানে ছিল শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষককক্ষ, অফিসঘর। আর সোজা নাক বরাবর এক সিঁড়ি। যেটা দিয়ে যাওয়া যায় দোতালায়।
তখন দোতলায় ছিল মেয়েদের বোর্ডিং, যেখানে প্রায় ৫০-৬০ জন মেয়ে থাকার ব্যবস্থা ছিল। এই তখন বলতে ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমলের কথা বলছি। স্কুলই ছিল আর কয়টা? আর মেয়েদের লেখাপড়ায় খাস্তগীরের সমতূল্য কেউ ছিল না। ফলে একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্রীরা আসতো এখানে পড়ালেখা করতে। নোয়াখালী, ফেনী থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির দূর্গম অঞ্চল থেকে আসতো ছাত্রীরা। এমনকি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির রাজার মেয়েরাও এই স্কুলের বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পানছড়ি এলাকা থেকে ছাত্রীরা আসতেন পড়তে, এমন নজিরও আছে। যূথিকা নামে এমন এক রাজকুমারীর কথা জানা যায়। যিনি ছিলেন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির মং রাজার কন্যা। অথচ, এটা সেসময় তাদের এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল হাতি!
বৃহস্পতিবার ছিল আনন্দের দিন
লেখাপড়া বাদেও, যে দিকটির জন্য খাস্তগীর বাবা মায়েদের কাছে আজও এক নম্বর স্কুল, তা হলো এর নিয়মানুবর্তিতা। শুরু থেকে খাস্তগীর স্কুল ছিল নিয়মশৃঙ্খলায় খুব কড়া। যেমন, এক প্রাক্তন ছাত্রী জানিয়েছেন, হোস্টেলের নিয়মানুযায়ী সকাল সাড়ে ছয়টার আয়া সবগুলো শোবার ঘরে হাত ঘন্টা বাজিয়ে যেত। ঘন্টা বাজার সাথে সাথে পিটির জন্য নিচে মাঠে নেমে যেতে হতো ছাত্রীদের। সাতটায় নাস্তা সেরে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত হোস্টেল সুপারের উপস্থিতিতে নিচে শ্রেণিকক্ষে ক্লাসের পড়া তৈরি করতে হতো। এরপর সাড়ে দশটার মধ্যে গোসল সেরে স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতো।
স্কুলের ভবনের পেছনে এখন যেখানে বিজ্ঞান ভবন, সেখানে ছিল একটি কুয়ো। সেই কুয়োর পাড়ে বেড়া দিয়ে তৈরি চারটি বাথরুম ছিল। দুজন করে বাথরুমে যেত, প্রত্যকের জন্য সময় বরাদ্দ থাকত ২০-২৫ মিনিট। গোসলের পালারও একটা তালিকা ছিল। এরমধ্যে তৈরি হয়ে সাড়ে নয়টার মধ্যে ভাত খেয়ে ক্লাসে আসতে হতো। ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে লাইন করে তৎকালীন উর্দু জাতীয় সংগীত 'পাকসার জমিন সাদ বাদ' গাওয়া হতো। এরপর স্কুল ছুটির পর হাত মুখ ধুয়ে কাপড় চোপড় ভাজ করে মশারী টাঙ্গিয়ে নিচে নামতে হতো খেলাধুলার জন্য। সন্ধায় ছয়টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করে ঢুকতে হতো 'স্টাডি রুমে'। রাত নটায় পড়া শেষ করে রাতের টিফিন খেয়ে যে যার বিছানায় চলে যেত।
বৃহস্পতিবার ছিল আনন্দের দিন। মাগরিবের পর হতো মিলাদ, আর রাত্রে ছিল পরোটা ও খাসীর মাংসের আয়োজন। পরের দিন শুক্রবার ছিল সাজগোজ ও কাপড় পরার স্বাধীনতার দিন। ছাকিনা ইউসুফ নামে একজন স্কুল ম্যাগাজিনে লিখেছেন, 'আমার সহপাঠী মানিকছড়ির মং রাজার মেয়ে যূথিকা হোস্টেলেই থাকত। তার ছিল ফ্রেশ শিফন, জর্জেট ও আরও দামি দামি শাড়ি। শুক্রবারে পালা করে আমরা যূথির শাড়ি পড়তাম। এছাড়া বিশেষ দিনগুলোতে পোশাক ছিল লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, ছোটো মেয়েদের সাদা ফ্রক।'
প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি
এই ৫০-৬০ জন ছাত্রীর জন্য ভবনের দোতালায় বরাদ্দ ছিল মোট চারটি হলরুম। প্রতি রুমে ১৪/১৫ করে জন থাকত। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং হোস্টেল সুপারও থাকতেন দোতলায়। তারা বাস করতেন বাকি তিনটি কক্ষে। রাস্তা থেকে এখন আমরা ভবনের যে পাশটা দেখতে পাই, হোস্টেল থাকাকালীন সে ঘরটা ছিল নামাজ ঘর। নামাজ ছাড়া মেয়েদের নিষেধ ছিল সেদিকে যাতায়াত করা। তাই ওদিকটায় পা-ই মাড়াতো না ছাত্রীরা।
তাদের ওঠানামার জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক লোহার ঘোড়ানো সিঁড়ি। হোস্টেলের মেয়েরা স্কুল টাইমে দোতালায় ওঠানামা করত পেছনের ঐ লোহার সিঁড়ি দিয়েই। প্রায় অন্ধকার একটা ছোটো ঘরের মধ্যে অবস্থিত এই সিঁড়ি এখন দেখলে মনে হবে পরিত্যক্ত শ্বাসরুদ্ধকর কোনো এক ছোট্ট ঘর। একসাথে দুজনের বেশি নামার জায়গাও বোধহয় হবে না। দেখলে এতটাই সরু মনে হয়! জং ধরা সেই লোহার সিঁড়ি দিয়ে– এটুকু জায়গার মধ্যে দিয়ে ছাত্রীরা কীভাবে ওঠানামা করত তা ভেবেই অবাক হতে হয়। সাহসের ব্যাপারই বটে!
ভূতের ভয়ে মেয়েরা দলবেঁধে বাহিরে যেত
এই লোহার সিঁড়ির মতোই ডা. খাস্তগীর স্কুলের ঝুড়িতে আছে নানা গল্প, কল্পকাহিনী। আর সেগুলোর প্লট তৈরি হতো কখনো পেছনের কুয়োকে ঘিরে, কখনো গাড়ির গ্যারাজকে ঘিরে, কখনো দুটো বড় বড় ঝাঁকড়া ডাল্পপালা বিশিষ্ট গাছকে ঘিরে, কখনো স্কুলের বিশাল অশ্বথ, পাকুড় গাছগুলোকে ঘিরে। এসব গাছে নাকি পেত্নীদের আস্তানা ছিল এবং এই তেঁনাদের কেউ কেউ নাকি দেখেছেও!
যেমন, টয়লেটের জায়গাটা ছিল স্কুলের পেছনে পশ্চিম দিকে। ঠিক টয়লেটের সামনেই একটা বিরাট শিরীষ গাছ ছিল। পেত্নী ভূতের ভয় তো আছেই, ভবন থেকে এতদূরে গাছপালার ভেতরে ছিল যে, দিনেরবেলাও একা একা টয়লেটে যাবার সাহস করত না ছাত্রীরা! বিশেষ করে সন্ধ্যের পর হোস্টেলের ছাত্রীরা মোটেই একা বের হওয়ার সাহস করতো না।
আবার গোসলখানায় যে কুয়োটি ছিল, সেই কুয়ো থেকে নাকি হাত উঠে আসত। আর দিত এক টান! কুয়োর কাছে গেলে– সে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবে, এই ভয়ে কেউ একা কুয়োর কাছেও যেত না। ছিল গাছ কাটলে রক্ত বের হওয়ার মতো গল্পও। পরে জানা গেল, সেগুন গাছ ছিল সেটি। গাছটি কাটলে একধরনের লাল কষ বের হতো। তা দেখে সবাই রক্ত ভেবে দৌড়ে পালাত।
এছাড়া, টিফিন টাইমে জানালার ধারে গল্পের বই পড়তে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, রাতে গাছগুলোতে লাল নীল আলো জবলতে দেখা, মাঝরাতে সাদাকাপড় পরা একজন মহিলাকে ফল খেতে দেখা, রাতে ভূতকে নাচতে দেখার মতো– গল্পকিসসা তো আছেই!
ভবনটি আগে ছিল হাসপাতাল
গল্প হোক আর কিসসা হোক, একথা সত্যি যে, কেমন এক গা ছমছমে ভাব স্কুলের এই ভবনটির সঙ্গে জড়ানো। অন্তত নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তাই বলতে পারি। স্কুলটির কাঠামোও ঠিক বিদ্যালয়ের মতো খোলামেলা না। দোতালার বারান্দাগুলোও রেলিং দিয়ে আটকানো। দোতলা পুরোটা পরিত্যক্ত হওয়ায়— যেন ভূতুরেভাব আরও স্পষ্ট। যেন কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে...
তবে এর ব্যাখাও পেলাম। স্কুলের এক কর্মচারী, আরিফুর ইসলাম নয়নের থেকে জানা গেল, স্কুলটি ১৯০৭ সালে স্থাপিত হয় ঠিকই, কিন্তু তারও আগে এটি ছিল একটি হাসপাতাল। এবং শোনা যায়, হাসপাতালের রোগীর মরদেহ, কংকাল, হাড় এসবই পড়ে থাকত পেছনের বাগানে। যেখানে আজকের বিজ্ঞান ভবন।
আবার অনেকের মতে, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ও এই স্কুলটি মর্গ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। ফলে স্কুল ঘিরে এই ভয়গুলো সেখান থেকেই উদ্ভূত বলে মনে করেন শিক্ষক আমির হোসেন। তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে হাসপাতাল হবার আগেও– নাকি এই স্কুলটি ছিল এক জমিদারের বাড়ি।
এক আদর্শের নাম
স্কুলের প্রাঙ্গণ এখন সম্পূর্ণই বদলে গেছে, সেই প্রধান ভবনটি ছাড়া। ১৯৫২ সালের দিকে দোতালা স্কুল বিন্ডিংসহ আশেপাশে পেছনে কিছু একতলা ঘর ছিল। উত্তরের টিনের বাড়িটা ভেঙ্গে সেখানে পরে বিজ্ঞান বিভাগ করা হয়। বাউন্ডারির কাছ ঘেঁষে ছিল রান্নাঘর, স্টোররুম। মাঝামাঝি স্থানে একটা টিনের ঘর ছিল, যেখানে টিফিন খেত মেয়েরা। পেছনের খোলা উঠানে ছিল টকটকে লাল রঙের একটা একটা প্রকাণ্ড কৃষ্ণচূড়া গাছ। বসন্ত এলে সেই গাছের নিচে লাল ফুলে ভরে যেত আর ছাত্রীরা সে ফুল কুড়িয়ে তা দিয়ে তৈরি করত মালা। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো স্কুল সংলগ্ন পেছনের মাঠে। এই জায়গাটা ছিল ছোটো ছোটো টিলা টংকরে ভরা পরিত্যক্ত জায়গা। তখন বকুলতলায় ক্লাসের লম্বা বেঞ্চ জড়ো করে স্টেজ বানানো হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। পেছনে অনেকগুলো গ্যারেজ ছিল। সেখানে বেশকিছু পুরোনো পরিত্যাক্ত গাড়ি রাখা ছিল। গাড়িগুলো কোন সময়ের তা শিক্ষকরাও সঠিক করে বলতে পারেন না। তবে তাদের ধারণা, হয়তো হাসপাতালেরই হতে পারে। অর্থাৎ স্কুলটি হওয়ারও আগে থেকে সেখানে গ্যারেজ।
তবে ভূতুরে বা পরিত্যক্ত যাই হোক, চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় তার মর্যাদা ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই। চট্টগ্রামবাসীদের কাছে ডাঃ খাস্তগীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এক আদর্শের নাম।
তিনজন ছাত্রী নিয়ে শুরু
এদেশে শিক্ষার প্রসার হওয়ার পর যে কয়টি স্কুল হয়, তারমধ্যে চট্টগ্রামের প্রথম ইংলিশ স্কুল ছিল চট্টগ্রাম জিলা স্কুল। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬ সালে। এরপর ধীরে ধীরে চট্টগ্রামে আরও স্কুল স্থাপিত হতে থাকে। ১৮৭১ সালের মধ্যেই এই অঞ্চলে ৩৮টি সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের পত্তন হয়। আস্তে আস্তে সামনে আসতে থাকে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও। ১৮৭০ সালে ব্রাহ্মসমাজের নেতা নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন 'অন্তঃপুর স্ত্রী সভা', এরপর গড়ে ওঠে আরও ছোটো বড় নানা প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রামেও নারী শিক্ষা প্রসারে নানারকম উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। আর এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে ডা. খাস্তগীর বিদ্যালয়টি। ১৮৭৮ সালে নারী শিক্ষানুরাগী ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর একটি ভার্নাকুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে ১৯০৭ সালে তার জামাতা যাত্রামোহন সেন (তৃতীয় কন্যা বিনোদিনীর স্বামী) এই স্কুলটিকে ভূমি ও ভবন দান করে অন্নদারণ খাস্তগীরের নামানুসারে নামকরণ করেন। পরবর্তীকালে স্কুলটিকে মাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীত করে বিদ্যালয়ের সরকারীকরণ করা হয়।
মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময়ে। এই প্রথম তিন ছাত্রী হলেন- আন্না সেন, প্রেম কুসুম ও জুনি এবং প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন সুশীলা সেনগুপ্তা এবং প্রধান শিক্ষিকা নির্মলা। ১৯৬০ সালে প্রদেশের মোট ২০ টি স্কুলের সাথে একেও পাইলট স্কিমের অধীনে আনা হয়। এরপর ১৯৬১ সালে এটি মাল্টিলেটারাল স্কুলে পরিণত হয়। যেখানে ১৯৩৭ সালেও তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে মোট ছাত্রী সংখ্যা ছিল দেড়শ, কি দুইশো। সেখানে দিনকে দিন স্কুলের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে– ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয় প্রাতঃ বিভাগ ও দিবা বিভাগ – দুই বিভাগে শিক্ষাদান। যা এখনো চালু আছে। এখন বর্তমানে স্কুলটির ছাত্রী সংখ্যা ২,১০০-২,২০০। শিক্ষক আছেন মোট ৫০ জনের মতো দুই বিভাগ মিলিয়ে।
কে ছিলেন ডা. খাস্তগীর?
ভারতবর্ষের প্রথম প্রজন্মের গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকদের মধ্যে ডা. খাস্তগীর ছিলেন অগ্রগণ্য। শুধু চিকিৎসক নয়, সমাজ সংস্কারক ও প্রবন্ধলেখক হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিল। ১৮২৯ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নিজের খুব কাছের সহপাঠীকে এক রাতের কলেরায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে তিনি ঠিক করেন, বড় হয়ে ডাক্তার হবেন।
বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও তার হৃদ্যতা ছিল। ১৮৮৭ সালের ২১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সময় বিদ্যাসাগর উপস্থিত থাকতে না পারায় না-কি বিদ্যাসাগরের আফসোসেরও অন্ত ছিল না।
ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন ডা. খাস্তগীর। বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
নারী শিক্ষার সাথে জড়িত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু-এই নামগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ডাঃ অন্নদাচরণ খাস্তগীরের নামও। এমনকি ব্রাহ্মমন্দিরে উপাসনার সময় নারীদের অংশগ্রহণের পক্ষে যারা প্রথম আওয়াজ তোলেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি নিজে পরিবারের নারীদেরই প্রথম নিয়ে এসেছিলেন ব্রাহ্ম মন্দিরের উপাসনায়।
"পরে তাহদের মধ্যে আপোধ হইয়া যায় এবং ব্ৰহ্মমন্দিরে মহিলাগণের বসিবার জন্য পৃথক স্থান নির্দিষ্ট হয়। তাহাদিগের মধ্যে ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর এবং দুর্গামোহন দাস, প্রথমে পরিবারের মহিলাগণ সহ যবনিকার বাহিরে সকলের মধ্যে বসিতে আরম্ভ করেন বিধবা বিবাহ–সংক্রান্ত কর্মকালে তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।" (জীবনীকোষ-ভারতীয় ঐতিহাসিক-দ্বিতীয় খণ্ড , পৃ ২৩৯)
ডা. খাস্তগীরের তিন পুত্র ও চার কন্যা ছিল। কন্যাদেরও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তৃতীয় কন্যা বিনোদিনীকে বিয়ে দেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত জমিদার যাত্রামোহন সেনগুপ্তের সঙ্গে। আর ছোটো মেয়ে কুমুদিনী খাস্তগীর চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট।
যেন যুদ্ধের ক্ষত গায়ে মেখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে
ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল পার হয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে স্কুলটি। বাহিরের ব্যস্ত জামাল খানের সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্কুলের ভবনটিকে ঠিক যেন স্কুল না, প্রাচীন আমলের এক পরিত্যক্ত ভবন বলেই মনে হয়। যেন যুদ্ধের ক্ষত গায়ে মেখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। আসলেও তো তা-ই! ১৯৭১ সালের এক সকালের ঘটনা। দশটার ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ বিকট শব্দে স্কুল কেঁপে উঠলো। ছাত্রী, শিক্ষক সবাই কান্নাকাটি করে ভয়ে বেরিয়ে এলেন। পরে দেখা গেল, দেয়ালের এক কোণে একটি টাইম বোমা রাখা হয়েছিল। সেই বোমায় কোনো হতাহত না ঘটলেও, বিশাল প্রাচীরে ফাটল আর গেইটের সুন্দর মাধবীলতার ফুল, লতাপাতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
১৯৮৭ সাল থেকে এই হোস্টেলটি বন্ধ হয়ে যায়। উপরের ছাদ, মেঝেতে ফাটল ধরায় পুরো ভবনটিই ঝুকিপূর্ণ এখন। যদিও প্রশাসনিক কাজে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে নিচতলাটি। আর উপরের তলাটি পুরোপুরি তালাবদ্ধ এবং পরিত্যক্ত। ভবনটি ভেঙ্গে নতুন করে ভবন বানানোর জন্য অনুরোধ জানালেও, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষার নিমিত্তে ভবনটি ভাঙ্গার অনুমতি মেলেনি স্কুল কর্তৃপক্ষের। জীবন ঝুঁকি নিয়ে ফাটল ধরা ছাদের নিচে বসে কাজ করে যাচ্ছেন শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ।
আদর্শ আর ঐতিহ্যকে নিয়েই টিকে থাকতে চায়
একসময় সেরা বিদ্যাপীঠের বিবেচনায় ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলকে ধরা হতো, আর চট্টগ্রামে ধরা হতো খাস্তগীর স্কুলকে। ১৯৫৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় 'সাকেবা খান' নামের এক ছাত্রী প্রথম স্থান অধিকার করলে, কামরুন্নেসা স্কুলকেও হার মানায় এ বিদ্যাপীঠ। লেখাপড়ালেখার পাশাপাশি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গার্লসগাইড, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত খাস্তগীরের ছাত্রীরা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখনো খাস্তগীরকে চট্টগ্রামের সেরা 'গার্লস' স্কুল হিসেবেই ধরা হয়।
এবছরও জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ–২০২৪ এর ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় – দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে – চট্টগ্রামের নারী শিক্ষা বিস্তারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সারাদেশে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রীতিলতা, কলনা দত্ত ছাড়াও ভাস্কর্য শিল্পী নভেরা আহমেদ, রাজনীতিবিদ ও নারীনেত্রী আইভী রহমান, মেরি কুরী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাকেবা আলী, সফল গীতিকার, ও রম্য লেখিকা হিসেবে খ্যাত ফাহমিদা আমিন, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ নীলুফার জহুর, বিখ্যাত কার্ডিওলোজিস্ট প্রফেসর, ড. সুফিয়া রহমানসহ আরও অসংখ্য গুণীজন তাদের স্কুলজীবন কাটিয়েছেনে এই বিদ্যালয় অঙ্গনে।
তারা সবাই আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন এই বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে। সঠিক মেধা যাচাই এবং নিয়মশৃংখলা বজায় রাখতে প্রতিবছর ভর্তিপরীক্ষার মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হতো। যদিও করোনার পর থেকে লটারি পদ্ধতি চালু হওয়ায়– তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, তাতে শিক্ষার মানে যেন হেরফের না হয়, সেদিকেও নজর রাখছেন প্রধান শিক্ষক। চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেদের আদর্শ আর ঐতিহ্যের ধারাকে বজায় রেখে চলতে।