জুলাই বিপ্লবের নেপথ্যের নায়ক: স্থানীয় হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা যখন ত্রাতা হয়ে এসেছিল
গত ৪ আগস্ট মিরপুর ১০-এর ডা. আজমল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তরুণ চিকিৎসক আকিব আহমেদ। প্রথমে মনে হয়েছিল দিনটা আর দশটা দিনের মতোই—কয়েক ঘণ্টা পরপর এক-দুজন রোগী নিয়ে আসা হচ্ছে চিকিৎসার জন্য।
কিন্তু দুপুর ১২টার পর ওই এলাকায় সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নরক গুলজার শুরু হলো। একের পর এক আহত আন্দোলনকারীদের নিয়ে আসতে শুরু করল শিক্ষার্থীরা। পেলেট, রাবার বুলেট, তাজা গুলি—সব ধরনের বুলেটে আহত শিক্ষার্থী ছিল আহতদের মধ্যে।
জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার আকিব সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, 'অন্তত তিনজনের মাথায় তাজা গুলির আঘাত লেগেছিল। তাদের মধ্যে দুজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। তৃতীয়জনের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক, তাকে আমরা সরকারি হাসপাতালে রেফার করে দিই; তার চিকিৎসা করা সম্ভব ছিল না।'
মধ্য-জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। হাসপাতালে ঠাঁই হতে থাকে আহত বিক্ষোভকারীদের।
রাজধানীর বিখ্যাত হাসপাতালগুলো, যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল আহতদের চিকিৎসায় এবং হতাহতের সংখ্যা কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এখনও হাসপাতালগুলো সে কাজ করে যাচ্ছে।
তবে স্থানীয় হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, সে কথা না বললেই নয়।
১৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত স্থানীয় হাসপাতালগুলো শত শত আহত বিক্ষোভকারীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে, বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে। আর এ কাজ তারা করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুন্ডাদের চাপ উপেক্ষা করেই।
১৯ জুলাই ও ৪ আগস্টের মতো দিনগুলোতে হাসপাতালগুলোতে বানের জলের মতো আহত আন্দোলনকারী আসছিল—ফলে তাদের রেকর্ড রাখাও সম্ভব হচ্ছিল না। এ লড়াইয়ের একেবারে সম্মুখভাগে থেকে কাজ করেছেন, এমন কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে টিবিএস। এ চিকিৎসকরা জানান, মাঝে মাঝেই তারা ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন, তবে আহতদের সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে খুশিও হয়েছিলেন।
মিরপুর-১০ নম্বর মোড়ের কাছাকাছি অবস্থিত যেসব হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেগুলোর একটি আজমল হাসপাতাল।
ডা. আকিব বলেন, 'আহতদের আমরা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দিয়েছি, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছি, আর প্রয়োজনে আইভি স্যালাইন দিয়েছি। গুরুতর আহতদেরকে স্পেশালাইজড হাসপাতালে পাঠানোর আগে তাদের রক্তক্ষরণ কমানোর চেষ্টা করেছি। এর বেশি কিছু আমরা করতে পারিনি।'
এই তরুণ চিকিৎসক আরও বলেন, 'একপর্যায়ে হাসপাতালের সামনেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আহতদের চিকিৎসা করতে হয়েছে আমাদের। (জায়গা সংকটে) মেঝেতেও শুইয়ে রাখা হয়েছিল আহতদের। হাসপাতালের সাতজন ডাক্তার আর সব নার্স একসঙ্গে জরুরি বিভাগে কাজ করেছেন।'
আকিব জানালেন, তিনি এর আগে কখনও এভাবে স্রোতের মতো আহত মানুষ আসতে দেখেননি। টানা ৪৮ ঘণ্টা কাজ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'বাইরে বেরোনো এমনিতেও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তাই আমরা ভেতরেই থেকে যাই। তাছাড়া শিফট বদলালে সময় নষ্ট হতো।
'চারপাশে এত রক্তপাত হচ্ছিল যে আমি ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।'
তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এসে হুমকিও দিয়ে গিয়েছিল, যাতে কোনো আন্দোলনকারীর চিকিৎসা করা না হয়। কিন্তু আজমল হাসপাতালের পরিচালক ডা. জুবায়ের বিন জামাল সব হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে চিকিৎসকদের বলেন তাদের সাধ্যমতো আহতদের চিকিৎসা দিতে।
এ হাসপাতালে সব ওষুধ, স্যালাইন ও চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
আকিব জানালেন, আন্দোলনের সময় সব মিলিয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার আহত মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল তাদের হাসপাতালে।
'এত বেশি মানুষ এসেছিল যে আহতদের রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়নি,' বললেন এই চিকিৎসক।
আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে কাজ করেন আবদুল হামিদ। এই চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা আরেকটু বেশি। এবারের আন্দোলনে আহতদের হাসপাতালে আনার সংখ্যাকে তিনি তুলনা দিলেন ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সঙ্গে। ওই সময় তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজে কাজ করতেন। তার মতে, এবারের ঘটনায় একমাত্র তফাত হচ্ছে, এবার হাসপাতালে আসছিল বুলেট আর সরাসরি মানুষের মারে আহতরা।
১৯ জুলাই ডিউটিতে ছিলেন ডা. হামিদ। সেদিন মিরপুর ১০ ও আশপাশের এলাকা আন্দোলনকারী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের হটস্পট হয়ে ওঠে। তার অভিজ্ঞতাও ডা. আকিবের মতোই।
হামিদ বলেন, 'আহতদের শরীর থেকে যতগুলো সম্ভব পেলেট বের করেছি আমরা। অনেকে মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে এসেছেন, তাদেরকে সরকারি হাসপাতালে রেফার করতে হয়েছে। আমরা সেদিন ৪০-৪৫ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি।'
এই চিকিৎসক বলেন, 'প্রত্যেক ভিক্টিমকে ৪-৫ জন লোক নিয়ে আসছিল। তাই হাসপাতালে ভীষণ ভিড় জমে যায়। ইমারজেন্সিতে আমাদের মাত্র তিনটি বেড আছে। কাজেই পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল, নিশ্চয় কল্পনা করতে পারছেন। যারা বসতে পারছিল, তাদের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছিল।'
একই হাসপাতালে গত ৪ আগস্ট জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. আজিম। তিনি জানান, বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আহত বিক্ষোভকারীদের আনা হয়েছে হাসপাতালে। সংঘর্ষের অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়নি। তবে সংঘর্ষে আহত আনুমানিক ৩০-৪০ জনকে সেদিন প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।
'ডা. আজিম বলেন, 'মানুষের চাপ অনেক বেশি থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আমরা আহতদের নামও জানতে পারিনি।
'আমরা সম্পূর্ণ মানবিক দিক বিবেচনায় কাজ কাজ করেছি। বেসরকারি হাসপাতাল হলেও আহতদের কাছ থেকে আমরা কোনো ফি নিইনি। আমি রোগীদের সাহায্য করতে পেরেছি এবং আমার হাসপাতাল বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।'
তিনি বলেন, 'এমনকি হাসপাতালের মালিক ডা. সাবের নিজে এসে আমাদের সঙ্গে মিলে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।'
এর আগে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার সব হাসপাতালই গণঅভ্যুত্থানের সময় ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখেও আহতদের চিকিৎসায় এরকম ভূমিকা রেখেছে। কিছু জায়গায় তো ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডারা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে আহত আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছে, তাদের চিকিৎসা করতে ডাক্তারদের বাধা দিয়েছে।