ঠাটারিবাজারের কেরোসিনের ল্যাম্পপোস্ট: শত স্মৃতি নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে
বারাসাতের মো. ইসরাইল থাকতেন কলকাতায়। সেখানকার রাস্তায় গ্যাসের বাতি দেখেছেন, কুপির পেটে চুনের সঙ্গে পানি ঢুকিয়ে দিলে যে বুদবুদ তৈরি হতো, তা থেকেই জ্বলত গ্যাস-বাতি। বাতিগুলো চারকোণা চিমনির খোলসে বন্দি থাকত একটি ঢালাই লোহার দণ্ডের মাথায়। চিমনির ফ্রেম হতো এনামেলের। চিমনির যেখানে শুরু সেখানে ছিল আড়াআড়ি আরেকটি লোহার দণ্ড। এর গুরুত্বও নেহাৎ কম ছিল না। 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'য় ভালো বর্ণনা আছে কলকাতায় গ্যাসবাতি আসার পরের সন্ধ্যাবেলার ছবির, 'সন্ধ্যা হলেই পুরসভার মুটে বগলে মই নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতো পথে পথে আলো জ্বালতে। মই বেয়ে ল্যাম্পপোস্টে উঠে প্রথমে ন্যাকড়া বুলিয়ে পরিষ্কার করত আলোর শেডের কাচ। তারপর চাবি ঘুরিয়ে চালু করত গ্যাস। সবশেষে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরাতো বাতি।' পুরসভার মুটে ওই আড়াআড়ি লোহার দণ্ডেই ঠেকা দিত মইয়ের ওপরভাগ, নইলে কুপোকাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কলকাতায় প্রথম গ্যাসবাতি জ্বলেছিল ১৮৫৭ সালের ৬ জুলাই। তার আগে জ্বলেছিল কেরোসিন তেলের বাতি।
দেশভাগের পর পর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এলেন ইসরাইল। এখন তার বয়স আটাশি, সে হিসাবে সাতচল্লিশ সালে বয়স ছিল বারো। ঢাকায় এসে কিছুদিন ছিলেন মৌলভীবাজার। তারপর চলে আসেন ঠাটারিবাজার। সংসারে অভাব ছিল বলে কাজে লেগে গিয়েছিলেন। ঠাটারিবাজারে একটি তিন মাথার মোড় বটতলা নামে প্র্রসিদ্ধ। সেখানে বয়স্ক দুই দোকানির একজন আমায় ঠিকই পথ দেখিয়ে দিতে পারলেন যখন আমি জানতে চেয়েছিলাম, কেরোসিন বাতির ল্যাম্পপোস্ট এখানে কোথায় আছে?
বটতলা থেকে সোজা পশ্চিম দিকে হেঁটে গেলে বাঁদিকে একটি গলি পাওয়া যায়। গলি ধরে যাওয়ার কিছু পরেই তাহেরবাগ শুরু হয়, বোবার স্প্রিংয়ের দোকানের গা ঘেঁষে ১১ নম্বর তাহেরবাগ বাড়িটির মুখেই ওই ল্যাম্পপোস্ট। তবে আধুনিক কালের মোটাতাজা এক ল্যাম্পপোস্ট একে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, তাই ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝা মুশকিল। পোস্টটির ঊর্ধ্বাংশ খালি থাকলেও সিঁড়ি লাগানোর ক্রসটা আছে। উচ্চতায় ৭ ফুটের মতো হবে। এক এলাকাবাসী বললেন, "আরো প্রায় ৭ ফুট দেবে আছে, কারণ রাস্তা উঁচু হয়েছে। এতদিনেও (১০০ বছর প্রায়) লোহায় জং ধরেনি, কোনো অংশ ক্ষয়ে যায়নি, ব্রিটিশ বলে কথা!"
তাহেরবাগ ওয়ার্কশপ এলাকা, গলির দুই ধারে বেশ কয়েকটি লেদ মেশিনের দোকান। মো. ইসরাইল বোবার স্প্রিংয়ের দোকানের ম্যানেজার। এখনো টান টান তার দেহ, চুল পুরো সাদা হয়ে যায়নি, চোখ ঘোলাটে হয়ে এলেও দেখতে অসুবিধা বোধ করেন না, পরিপাটি পোশাকআশাক। ঢাকায় এসে ইসরাইল ইলেকট্রিক সড়কবাতি দেখেছেন বেশি, কেরোসিন-বাতিও কম দেখেননি। পৌরসভার কর্মীরা প্রতি সন্ধ্যাতেই আসত বাতি জ্বালাতে। নিভিয়েও দিয়ে যেত ভোরবেলাতেই। তাদের কাঁধে থাকত মই, আর আরেক হাতে কেরোসিনের কাইড়া (লোহার আংটা লাগানো টিনের বাক্স)। ল্যাম্পপোস্টগুলো সব বিলাত থেকে আনা হতো বলে জানতে পেরেছেন তিনি।
ঢাকার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে ঢাকা কেন্দ্র। এর পরিচালক আজিম বখশ, যিনি মওলা বখশ সর্দার মেমোরিয়াল ট্রাস্টেরও চেয়ারম্যান টিবিএসকে বললেন, "ঢাকা পৌরসভার দুটি জোরদার কাজ ছিল– যার একটি ওই রাস্তা আলোকিত করা। কেরোসিনের বাতিগুলো ছিল মূলত গলিতে, আর সড়কে ছিল বৈদ্যুতিক বাতি। বাতি জ্বালানো ও নেভানোর সময় নির্ধারিত ছিল। মাসভেদে সময় বদলাতো কারণ ডিসেম্বর আর জুলাইয়ে তো সন্ধ্যা একই সময়ে হয় না। বাতি জ্বালানো ও নেভানোর জন্য একটি আলাদা পেশাজীবী গোষ্ঠি তৈরি হয়েছিল সে সময়।"
"আমাদের ট্রাস্টের হাসপাতালে ঢোকার আগে বাঁ ধারে একটি স্টেশনারি দোকান দেখবেন, পাকিস্তান আমলে সেখানে যিনি দোকানদারি করতেন, তার নাম ছিল দক্ষিণারঞ্জন রাউত। তিনি পৌরসভার বাতিওয়ালা ছিলেন। কেরোসিনের বাতি আমি প্রথম দেখেছি ১৯৫৩-৫৪ সালে, তখন আমাদের কাগজীটোলায় সোস্যাল ক্লাব থেকে সবজিমহল মসজিদ পর্যন্ত ৪-৫টি বাতি ছিল। মই আর কাইড়া নিয়ে বাতিওয়ালাদের সন্ধ্যাতে হাজির হয়ে যেতে দেখতাম, মইকে তখন সিঁড়িও বলত অনেকে। সিঁড়ির ডগায় চড়ে চিমনির দরজা খুলত বাতিওয়ালারা। কুপির পেটে কেরোসিন ঢেলে সলতে বাড়িয়ে দেশলাই ঠুকে আলো জ্বালিয়ে দিত। সে আমলের ঢাকায় জমিদার বা বড় ব্যবসায়ী ছাড়া কারোর বাড়ি দোতলা হতো না। লাম্প্যপোস্টগুলো ১৫ ফুট উঁচুও হতো। বাতিওয়ালারা তাই সিঁড়ি লাগানোর আগে হাঁক ছাড়তেন, বাড়ির মা-বোনেরা সব সরে যান," বললেন তিনি।
কবি শামসুর রাহমান তার 'স্মৃতির শহর' বইয়ে এই বাতিওয়ালাদের যাদুকর বলে উল্লেখ করে লিখেছেন, 'আমি রোজ অপেক্ষা করতাম, কখন সূর্যিমামা পশ্চিম আকাশ থেকে তাঁর রঙিন গালিচাটা গুটিয়ে নেবেন, কখন ছায়া নামবে গলিতে। কারণ সূর্যের আলো ফুরোলেই বাতিঅলা আসবে আলো জ্বালানোর খেলা খেলতে। গলির শেষ সীমার বাতিটায় আলোর ফুল ধরবে, নরম তুলতুলে আলোর ফুল। বাতিঅলা মই বেয়ে উঠবে, ফতুয়ার পকেট থেকে কী একটা বের করবে, তারপর গলিতে আলোর কলি, যেন কোনো যাদুকর সন্ধ্যের বোঁটায় ঝুলিয়ে দিয়েছে আলোর ফুল, আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে। তখন ইচ্ছে হতো বাতিঅলাকে ডেকে বলি:
বাতিঅলা করছো তুমি
কী যে মজার কাজ।
পরিয়ে দিয়ে সাঁঝের গায়ে
আলো-জরির সাজ।'
ঢাকার রাস্তায় কেরোসিনের ল্যাম্পপোস্ট জ্বলেছিল ১৮৭৭ সালে। এর আগের বছরই ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধি ধারণ করেন। এ উপলক্ষে ঢাকাবাসীদের নিয়ে একটি উদযাপন কমিটি হয়। কমিটির উদ্যোগে সাড়ে ৬ হাজার টাকার একটি তহবিল গড়ে ওঠে। সে অর্থ দিয়ে ১০০টি সড়কবাতি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম দফায় ওয়াইজঘাটে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস থেকে চকবাজার পর্যন্ত ৬০টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়। দিনে দিনে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে এবং আরো আরো মহল্লায় ল্যাম্পপোস্ট বসানো হতে থাকে।
ঢাকার ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফী বললেন, "দ্রুতই কিন্তু বাড়েনি ল্যাম্পপোস্টের সংখ্যা, বড় কারণ স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকেই অর্থ যোগান দিতে হতো। এছাড়া, কেরোসিন সে আমলে সহজলভ্য ছিল না, ভারতবর্ষে ছিল না কোনো তেল সংশোধনাগার, তাই তেল আসত দূরবর্তী কোনো দেশ থেকে, বিলাত থেকেও হতে পারে। ব্রিটিশ আমলে কেরোসিন ছিল বিস্ফোরক দ্রব্যের তালিকায়, তাই সাধারণ্যে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পেট্রোল পাম্পগুলো যেমন সরকারি মালিকানায় ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রমনা পেট্রোল পাম্প তৈরি হয়েছিল মার্কিন ও ব্রিটিশ আর্মির যানবাহনের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বাহাদুর শাহ পার্ক সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পটি তৈরি হয়েছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের যানবাহনের জ্বালানি চাহিদা পূরণে।"
এখন তাহলে বলতে পারেন, কেরোসিন বাতির আগে কি ঢাকা রাস্তায় বাতি জ্বলত না? ঘরে ঘরেই বা কী জ্বলত? নিজের প্রশ্নে নিজেই উত্তর দিলেন হাশেম সূফী, "মুঘল আমলে মশালচী নামে পেশাজীবী গোষ্ঠী ছিল যারা রাস্তার মোড়ে মশাল জ্বালানোর কাজ করত। সেগুলোর জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হতো ঘানি ভাঙা তিল, তিসির তেল। এটা পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে চলেছে। ঘরে ঘরেও তিল, তিসির তেলের কুপি জ্বলত। মৌচাক থেকে মোম সংগ্রহ করে বাতিওয়ালারা মোমবাতি বানিয়েও বিক্রি করতেন।"
ঢাকা পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৪ সালে। তবে ইউরোপীয় স্টাইলে ঢাকা সাজানোর পরিকল্পনা পৌরসভা গ্রহণ করে ১৮৮৫ সালে। পৌরসভা অবশ্য মাসচুক্তিতে বাতিওয়ালাদের বেতন দিত, তারমধ্যে তেলের দামও অন্তর্ভুক্ত থাকত। যেমন– ১৮৯০ এর দিকে একজন বাতিওয়ালা পেতেন ১ টাকা ৭ আনা, ১৮৯৯ সালে পেয়েছেন ১ টাকা ৩ আনা। কারণ তেলের দাম কমে গিয়েছিল। ১৮৯৯ সালের আগে বছরে পাঁচ মাস বাতি জ্বালানো হতো, পরে আবার তিন মাস হয়ে গিয়েছিল।
আঠার শতকের গোড়ায় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে ঢাকা সমৃদ্ধি হারাতে শুরু করে। আর এটা বজায় থাকে উনিশ শতকের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত। ১৮১৪ সালে যেমন ঢাকায় বাড়ির সংখ্যা ছিল ২১ হাজার; ১৮৩৬ সালে সংখ্যাটা নেমে গিয়েছিল ১০ হাজারে। জাতীয় অধ্যাপক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাই সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, 'থ্রু নাইনটিনথ সেঞ্চুরি ইট ওয়াজ ডিক্লাইনিং।'
উনিশ শতকের সত্তরের দশকের ঢাকায় বাহন ছিল হাতি। ১৮৬৯ সালে ঢাকায় ঝামা বিছানো প্রধান রাস্তা ছিল চারটি যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য কয়েক মাইলের বেশি ছিল না। পৌরসভার কাজে গতি বৃদ্ধির পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ফলাফলে ১৮৯২ সালে ঢাকা বিভাগে পাকা বা মেটালড রোড ছিল ১৭০ মাইল, অনুমান করা কঠিন নয় যে এর অনেকটাই ছিল শহর ঢাকায়।
১৮৭০ এর দশকে ঢাকায় লোকসংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলতে গেলে ছিলই না। তাই নবাব আহসানউল্লাহ যখন বৈদ্যুতিক বাতির জন্য সাড়ে চার লাখ টাকা দান করলেন, তখন শর্ত দিয়েছিলেন যে বিনিময়ে পৌরসভা শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে। বিজলী বাতি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত হয়েছিল দ্য ঢাকা ইলেকট্রিক লাইট ট্রাস্ট। ট্রাস্টের পক্ষ থেকে পত্রিকায় প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় শহরের রহমতগঞ্জ, চকবাজার সার্কুলার রোড, মোগলটুলি রোড, নলগোলা রোড, বাবুবাজার রোড, কমিটিগঞ্জ রোড, আরমেনিয়া স্ট্রিট, ইসলামপুর রোড, আহসানমঞ্জিল রোড, পাটুয়াটুলি রোড, বাংলাবাজার রোড, ডাল বাজার রোড, ফরাশগঞ্জ, লোহারপুল রোড, দিগবাজার রোড, ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষীবাজার রোড, সদরঘাট রোড, শাখারীবাজার, জনসন রোড, নবাবপুর রোড, জামদানি নগর রোডে বিদ্যুৎ বাতি লাগানো হবে।
অবশেষে এলো সেই মহার্ঘ দিন, ৭ ডিসেম্বর ১৯০১ সাল। শহরে বিজলী বাতির আগমন উপলক্ষে আহসান মঞ্জিলে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। পরের দিন ঢাকা প্রকাশ এ নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশ করে, তার প্রথম অংশটা ছিল এমন- 'গতকল্য সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে, শ্রীযুক্ত নবাব বাহাদুরের অনুকম্পায় ঢাকা নগরীর প্রধান রাস্তাগুলি চপলা চমকে অকস্মাৎ হাসিয়া উঠিয়াছে।'
আজিম বখশ বলছিলেন, "বৈদ্যুতিক বাতি আসার পরেও অনেককাল পর্যন্ত কেরোসিন বাতির দাপট ছিল। তবে দুয়ে মিলিয়েও পোস্টের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। পঞ্চাশ দশকের ঢাকার রাত ছিল শুনশান। জনমনিষ্যির চলাচল ছিল নগণ্য। চুরি-ডাকাতির ভয় ছিল যেমন, আবার জ্বিন-ভুতের ভয়ও কম ছিল না। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আগাগোড়াই আড্ডাবাজ। তারা মাগরিবের নামাজ শেষে কাছের চায়ের দোকানে অথবা পঞ্চায়েত বাংলায় আড্ডা দিত, আর এশার নামাজের পরেই ঘরে ঢুকে পড়ত।"
হাশেম সূফীর অভিজ্ঞতাও একই রকম। বলছিলেন, "রাতে রাস্তায় লোকজন দেখাই যেত না। যারা খুব প্রয়োজনে বের হতো তারা দলবেঁধে পথ চলত। সিনেমা দেখার দলও জোরে জোরে গান গাইতে গাইতে পথ চলত। বাতি আসার পর ছায়া পড়ত বলে ভুতের ভয় যেন আরো বেড়ে গিয়েছিল।"
লক্ষ্মীবাজারের কাছে ঢাকার একটি প্রাচীন জনপদ রোকনপুর। বলা হয়ে থাকে, সুলতানি আমলে রোকনউদ্দিন চিশতী নামে এক দরবেশ এখানে বাস করতেন, তার নাম থেকেই হয় এলাকার নাম। রোকনপুরের ১ নং বাড়িতে বাস করেন হাশেম সূফী। পঞ্চাশের দশকে তিনি তাদের বাড়ির উত্তর ও পূর্ব কোণে দুটি ল্যাম্পপোস্ট দেখেছেন, যার একটি জ্বলত কেরোসিন তেলে, অন্যটি বিদ্যুতে।
বৈদ্যুতিক বাতির তুলনায় কেরোসিন বাতির অগ্রগতি ছিল অধিক ধীর। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যাাচ্ছে, ১৯৩৫ সালে ঢাকায় কেরোসিন বাতি ছিল ৮৬৯টি এবং বৈদ্যুতিক বাতির সংখ্যা ১,০৬৬টি। মানে আগের ৫৭ বছরে গড়ে ১৫টি করে কেরোসিন বাতি সংযোজিত হয়েছে। দেশভাগের সময়ের হিসাবটায় অবশ্য কিছুটা গতিবৃদ্ধি হয়েছে দেখা যায়। তখন কেরোসিন বাতি ছিল ১০৭০টি এবং বৈদ্যুতিক বাতি ১৩৭০টি।
হাশেম সূফী বললেন, "পরীবাগে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ছিল নবাবদের মালিকানায়। এটি ছিল কোলকাতায় নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। এর অনেক কর্মকর্তাই ছিলেন ইংরেজ। ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত এ প্রতিষ্ঠান। সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ছাড়াও মিন্টু রোড, নবাব বাড়ি, ডিসি হাউজ, রুপলাল হাউজে এখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। পরের দিকে এর পরিধি বিস্তৃত হয় এবং গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে। কয়লা দিয়ে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। আমি কুমারটুলিতে এদের অফিস দেখেছি। লাইন ধরে লোকজন বিদ্যুতের বিল দিতে যেত। তাদের কাছে বছরওয়ারি কার্ড থাকত। প্রতি মাসের বিল পরিশোধ হলে নির্দিষ্ট ঘরে পেইড সিল দেওয়া হতো।"
আজিম বখশ বললেন, "সোজা লোহারদণ্ড ছাড়াও আরেক ধরনের ল্যাম্পপোস্ট দেখেছি, সেগুলোও ঢালাই লোহা দিয়ে তৈরি হতো, তবে দেখতে হতো ইংরেজি এস অক্ষরের মতো। গেন্ডারিয়ার ভাট্টিখানায় যেখানে কাঠের পুল ছিল, তার কাছেই এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় হয়েছে। এখানে দুটি এস আকৃতির ল্যাম্পপোস্ট দেখেছি। সাধারণত রাস্তায় যখন পোস্ট বসানোর জায়গা পাওয়া যেত না তখন ধারে কাছের বাড়ির দেওয়ালে এগুলো বসানো হতো।"
উল্টিনগঞ্জের কেরোসিন ডিপোর কথাও পরিষ্কার মনে আছে আজিম বখশের। বুড়িগঙ্গার পারে ছিল এ ডিপো। সাইনবোর্ডটি ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেকদিন। যতীন কুমার দাশ ডিপোটি পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন বিকে দাশ রোডের লক্ষ্মীভিলার মালিকের বংশধর বা আত্মীয়। ঢাকায় এমন আরো কিছু ডিপো ছিল বলেই মনে করছেন আজিম বখশ; তবে সংখ্যায় যে অনেক বেশি তা নয়। রাস্তার বাতি ছাড়াও কেরোসিনের ব্যবহার ছিল হারিকেন, কুপি, হ্যাজাক বাতিতেও। তাহেরবাগের কেরোসিন বাতির অচল ল্যাম্পপোস্টটির নীচেই বসেন শামসুল আলম। প্লাস্টিকের বোতলে করে বিক্রি করেন কেরোসিন তেল। ওয়ার্কশপের মেশিনগুলোর জট ছাড়াতে বা কর্মীরা হাত-পায়ের দাগ ওঠাতে ব্যবহার করেন কেরোসিন। আজিম বখশ মহররম মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বড় বড় হ্যাজাক বাতি বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন।
হাশেম সূফী এবং আজিম বখশ দুজনেই শেষ কেরোসিন বাতি জ্বলতে দেখেছেন গেল ষাটের দশকের গোড়ায়। তারপর পোস্টগুলোর কী হলো? হাশেম সূফী বললেন, "অবহেলায় অনাদরে হারিয়ে গেছে। যারা দেখেছেন তারাও ভুলে গেছেন কোনো এক ফাঁকে। আমি একটি সংগ্রহ করে সংরক্ষণের জন্য ঢাকা নগর জাদুঘরকে দিয়েছিলাম, এখন আছে কি না বলতে পারব না।"
বাংলাদেশ মাঠের কাছে আছে মাজেদ সরদার সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র। এর চত্বরে একটি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করেছিলেন মাজেদ সরদারের ছেলে নাজির হোসেন এবং আজিম বখশ। এটি তারা সংগ্রহ করেছিলেন নাজিরাবাজার থেকে। ভাট্টিখানার এস আকৃতির একটি ল্যাম্পপোস্ট আজিম বখশ জাতীয় জাদুঘরকে দিয়েছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রের জন্য বানিয়েছিলেন একটি রেপ্লিকা বা অনুকৃতি। সম্ভবত এগুলোই ঢাকার কেরোসিন সড়কবাতির শেষ নমুনা।