স্নিকার্সের সাদা জমিনে যখন রঙতুলির কারুকাজ
ফুল, পাখি, রিক্সা আর্ট থেকে কে-পপ, অ্যানিমে চরিত্র- পছন্দ অনুযায়ী রঙতুলির আঁচড়ে সাজিয়ে তোলা হয় শখের জুতো জোড়া। পোশাকের মতো পরনে থাকা জুতাকে নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তুলতে, বাড়তি খরচা করতেও দু'বার ভাবেন না এই ক্রেতারা। কারণ ট্রেন্ডের সাথে তাল মেলানো চাই! তরুণদের মধ্যে এমন ট্রেন্ড মানার ঝোঁক বেশি কাজ করে। তাইতো নতুন ও ভিন্নধর্মী কিছুর ব্যাপারে এরাই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ইদানীং তরুণদের পরনে পেইন্ট করা একধরনের রঙিন স্নিকার্স দেখা যায়। জুতার দোকান ও শো-রুমগুলোতে এমন স্নিকার্স বিক্রি হতে দেখা না গেলেও, বর্তমানে ফ্যাশনের জগতে নতুন ট্রেন্ড হিসেবে রঙতুলি দিয়ে আকা স্নিকার্সের চাহিদা বাড়ছে। সাদা-কালো জুতার ভিড়ে নিজেদের শখ পূরণ করতে অনেকেই পেইন্ট করা স্নিকার্স জুতা কালেকশনে রাখতে চান। আর তাই স্নিকার্সের ওপর রঙতুলির আর্ট দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যা হালফ্যাশনে জায়গা করে নিচ্ছে।
জুতোর জমিন যখন ক্যানভাস
২০২০ সালে করোনার মধ্যে লকডাউনে দীর্ঘ সময় ঘরবন্দী হয়ে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন লাবিবা ইবনাত আলম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের সৃজনশীল ও ভিন্নধর্মী কাজের ভিডিও শেয়ার করতে শুরু করে তখন। ফিডে আসতে থাকা এমন সব ভিডিও দেখে, লাবিবার শখ হয় তিনিও কিছু করবেন। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তবে এবার ক্যানভাস হিসেবে সাদা কাগজ নয়, সাদা স্নিকার্সকে বেছে নিলেন।
শুরুর গল্প বলতে গিয়ে লাবিবা বলেন, "জুতোয় পেইন্ট করতে যে রঙ প্রয়োজন, সেগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। ২০১৬ সাল থেকেই আমি বিভিন্ন জিনিসের ওপর টুকিটাকি রঙ করতাম। করোনার সময় অন্যদের সৃজনশীল কাজ দেখে, ইচ্ছে হয় নিজের জন্য একজোড়া স্নিকার্স পেইন্ট করার। সে সময় আমেরিকা থেকে ঐ ৮টা রঙ (অ্যাঞ্জেলাস অ্যাক্রোলিক লেদার পেইন্ট) অর্ডার করে আনতে আমার প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো লেগেছিল। শিক্ষার্থী অবস্থায় ওটা আমার জন্য অনেক বেশি ছিল। চারিদিকে যখন জীবন-মৃত্যু নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে, তখন আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম, টাকা বেশি লাগলেও শখের এই কাজটি আমি করতে চাই। অর্ডারের প্রায় একমাস পর রঙ হাতে পেয়ে, বাড়িতে থাকা আমার একজোড়া স্নিকার্স পেইন্ট করি। সেখান থেকেই আমার নতুন এই কাজের শুরু হয়েছিল"।
একই জুতা কিন্তু অন্যদের থেকে আলাদা
লাবিবার পরনে আর্ট করা স্নিকার্স দেখে, তার সহপাঠী ও বন্ধুদের অনেকেই বায়না ধরেন তাদেরকেও পেইন্ট করা স্নিকার্স বানিয়ে দিতে। স্নিকার্স, রঙ, ডিজাইন- একাই সবকিছু করে থাকেন লাবিবা। ক্রেতাদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে, কী ধরণের আর কত টাকার স্নিকার্স কেনা হবে। তারপর সেগুলোর ওপর রঙতুলির আঁচড়ে বিভিন্ন ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয় । এই বিষয়ে জানতে তার অবশ্য প্রথমদিকে কিছুটা সময় লেগে গিয়েছিল। জানা যায়, শুরুতে করা ভুলগুলো থেকেই ভালোভাবে শিখতে পেরেছিলেন তিনি।
তরুণ আঁকিয়ে লাবিবা জানান, "স্নিকার্সের সাইজ সম্পর্কে আমার খুব একটা পূর্বধারণা ছিল না। পায়ের মাপের ক্ষেত্রে অন্য জুতার থেকে স্নিকার্সের সাইজ একটু ভিন্ন হয়। একজন গ্রাহকের জন্য স্নিকার্স অর্ডার করার পর দেখি, জুতাজোড়া তার মাপের তুলনায় ছোট হয়েছে। অবশ্য দু'বার এমন ঘটনা ঘটেছিল। তাই এ ব্যাপারে জানতে শুরু করলাম, যেন এমন সমস্যায় আর পড়তে না হয়। যেসব গ্রাহকরা নিজেদের স্নিকার্সের সাইজ জানেন না, তাদেরকে একটি সাইজ চার্ট দেওয়া হয়। সেটি দেখে তারা নিজেদের মাপ জানানোর পর, দেশের বাইরে থেকে জুতা অর্ডার করা হয়।"
"প্রথম যে স্নিকার্সটা কিনি ওটার দাম পড়েছিল ১৮ হাজার টাকার মতো। আমার মনে হয়েছিল দাম বেশি রেখেছে। স্নিকার্সের মানের ওপর নির্ভর করে দামের পার্থক্য হয়, এই বিষয়গুলোতেও শুরুতে আমার ধারণা তেমন ছিল না। আমাদের দেশে খুব কম মানুষ আছেন, যারা অরিজিনাল স্নিকার্স এতবেশি দাম দিয়ে কিনে থাকেন। বেশিরভাগ ক্রেতা যেহেতু শিক্ষার্থীরা, তাদের পক্ষে এতো দাম দিয়ে একজোড়া জুতা কেনা সম্ভব হয় না। তাই ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন গ্রেডের রেপ্লিকা স্নিকার্স কিনে আনা হয়। যেগুলোর দাম ২ হাজার থেকে ৫ হাজারের মধ্যে পড়ে। জুতার দাম বাদে তাদের থেকে এক্ষেত্রে বাড়তি কোনো অর্থ রাখা হয় না। স্নিকার্সের ওপর কী ধরণের নকশা হবে এবং সেটি করতে কী পরিমাণ রঙ প্রয়োজন হবে, তার ওপর চার্জ নির্ধারণ করা হয়"।
লাবিবা একজোড়া স্নিকার্স রঙতুলি দিয়ে নকশা করতে ২-৩ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ জমিন জুড়ে নকশা করার ক্ষেত্রে ৭/৮ হাজার টাকা পর্যন্তও রাখা হয়। শিক্ষার্থী অবস্থায় একজোড়া স্নিকার্স নকশা করতে তার ৩ সপ্তাহের মতো সময় ব্যয় হতো। ক্লাস, পরীক্ষা ও অন্যান্য কাজের ফাঁকে তাকে অবসর সময়ে এই কাজ নিয়ে বসতে হতো। তরুণ এই শিল্পী জানান, পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে তিনি একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে আছেন। ৮ ঘণ্টার অফিস শেষে বাড়ি ফিরে তার আর অন্য কাজ করার মতো শক্তি থাকে না। তাইতো ছুটির দিনে তার শখের রঙতুলি নিয়ে বসতে হয়। এজন্য তিনি আগে থেকেই গ্রাহকদের থেকে সময় চেয়ে নেন। বর্তমানে একজোড়া স্নিকার্স পেইন্ট করতে তার ৭-৮ সপ্তাহ লেগে যায়। যা গ্রাহকদের পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
শখের নেশাই যখন পেশা
সৃষ্টিশীল শিল্পীমন আর অভিনব ডিজাইনের মিশেলে লাবিবা ইবনাত আলম তুলি দিয়ে তৈরি করেন ট্রেন্ডি সব স্নিকার্স। সবার চেয়ে একটু আলাদা লুক এনে দেবে এবং অনন্য করে তুলবে—এমন জিনিসের দিকেই তারকা থেকে শুরু করে ফ্যাশনপ্রেমী তরুণ-তরুণীদেরও নজর থাকে। শুরুতে বন্ধু ও কাছের মানুষদের জন্যেই স্নিকার্স আঁকতো লাবিবা। তার রঙতুলির নিপুণ কারুকার্যের জন্য ধীরে ধীরে ক্রেতাসংখ্যা বাড়তে থাকে। এভাবেই লাবিবার ছোটবেলার আঁকাআঁকির নেশা তার পেশায় পরিণত হয়ে যায়।
'লাবেইবা পেইন্টিং অন র্যান্ডম স্টাফ' নামের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাবিবার একটি পেজ রয়েছে। করোনার মধ্যে তার আর্ট করা স্নিকার্স ও অন্যান্য জিনিসের ছবি শেয়ার করতে পেজটি খোলা হয়েছিল। বর্তমানে তার পেজের ফলোয়ার সংখ্যা ২৪ হাজার। দেশের বাইরে থেকেও লোকজন পেজের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করে স্নিকার্স পেইন্ট করে দেওয়ার অর্ডার দিয়ে থাকে। এভাবে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও লাবিবার ডিজাইন করা স্নিকার্স পৌঁছে গিয়েছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি রন্ধনশিল্পী কিশোয়ার চৌধুরী, লাবিবার আঁকা স্টাইলিশ স্নিকার্স পড়ে ছবি তোলার পর বিষয়টি অন্যদের নজরে আসে। সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার 'দেওরা' গানের মিউজিক ভিডিও-তে গায়ক প্রীতম হাসান লাবিবার আঁকা স্নিকার্স পরেন। তরুণ থেকে ফ্যাশন আইকন, সবার কাছেই হাতে আঁকা স্নিকার্সগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অবসর সময় কাটাতে শখ থেকে স্নিকার্সের ওপর নকশা করা লাবিবা, মাত্র ৩ বছরে ৩০০টির বেশি স্নিকার্স এঁকে বিক্রি করেছেন।
লাবিবা জানান, "বেশিরভাগ ক্রেতারা নিজেদের পছন্দমতো ডিজাইন জুতায় এঁকে দিতে বলেন। কে-পপ, বিভিন্ন অ্যানিমে চরিত্র, জেলার নাম থেকে শুরু করে অনেক রকম ডিজাইন থাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশিবার আঁকা হয়েছে রিকশা পেইন্টিং আর্ট। ১০০টির ওপর জুতায় রিকশা আর্ট করেছি, যেগুলোর বেশিরভাগ বিদেশে বাস করা বাঙালিরা নিয়েছেন। দূরদেশে অবস্থান করে দেশের প্রতি টান অনুভব থেকেই দেশীয় রিকশা আর্ট তাদের কাছে এতো পছন্দের ছিল। এখনো ৬০টির ওপর অর্ডার রয়েছে, যেগুলো সময় স্বল্পতার জন্য করতে পারছি না। ক্রেতাদের অনেকেই আমার ওপর ভরসা থেকে বলেন, আমার নিজের পছন্দের যেকোন ডিজাইন জুতায় এঁকে দিতে। সেক্ষেত্রে আমি নিজ থেকেই তাদের জন্য কিছু টাকা কমিয়ে রাখি। পেইন্টিং-এর জন্য প্রতিটি রঙ ও তুলি বাইরে থেকে অর্ডার করে আনা হয়। জুতার স্থায়িত্বকালের ওপর রঙের স্থায়িত্বকাল টিকে থাকে। অনেকে ভাবতে পারেন পানি ও অন্যান্য কারণে জুতার রঙ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অনায়াসে আর্ট করা স্নিকার্স পরে পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিং করা যায়। এগুলো পানিতে ধুয়ে নষ্ট বা উঠে যায় না।"
স্নিকার্সের পাশাপাশি লাবিবা লেদারের ব্যাগ, টি-শার্ট ও হুডিতে রঙ দিয়ে ডিজাইন করে থাকেন। পরিবারের সমর্থন থাকায় তিনি এই পেশাকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে চান। তার ভবিষ্যত লক্ষ্য হচ্ছে, পেজের পাশাপাশি একটি ওয়েবসাইট নির্মাণ করা। এতে করে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে বসবাস করা বাঙালি-অবাঙালি যে কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজে অর্ডার করতে পারবেন। ৯-৫টার কর্পোরেট জীবনে আবদ্ধ না হয়ে, নিজের শখের কাজটিকেই পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে চান তরুণ আঁকিয়ে লাবিবা।
'কিছুনা' থেকে নান্দনিক কিছু
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'কিছুনা' নামের পেজটি বেশ কিছুদিন ধরে আপডেট করা না হলেও, এখানে পাওয়া যায় পেইন্ট করা বিভিন্ন ডিজাইনের সুন্দর স্নিকার্স। এই পেজের স্বত্বাধিকারী গালিব একজন পেশাদার শিল্পী। ছোট থেকে আঁকাআঁকি করলেও ২০১৮ সাল থেকে তিনি স্নিকার্সের ওপর পেইন্টিং করে আসছেন। অর্ডার দেওয়ার মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে তিনি জুতায় পেইন্ট করে শুকিয়ে তা ক্রেতাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন।
গালিব তার কাজ সম্পর্কে বলেন, "ছোটবেলা থেকে আঁকতে ভালো লাগলেও, কাগজে আঁকতে ইচ্ছা করতো না। ছোটবেলায় দামি জুতায় আঁকার সাহস না করলেও, বড় হওয়ার পর তাই করতে শুরু করলাম। আমি যখন কাজটা শুরু করেছিলাম, তখন বাংলাদেশে এমন ট্রেন্ডের খুব একটা চল দেখা দেয়নি। শিল্পী মন থেকে জুতার ওপর রঙতুলি দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন আঁকতাম। অন্যদের পছন্দ অনুযায়ী কাস্টোমাইজ ডিজাইনও করে দিতাম। এখনো স্নিকার্সে আঁকাআঁকি করি, তবে পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসেও ডিজাইন করি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে, এমন মানুষরাই আমার থেকে পেইন্ট করা স্নিকার্স কেনেন। বিদেশী রঙের দাম অনেক বেশি। সে রঙ কিনে স্নিকার্সের ওপর ডিজাইন করতে গেলে জুতার দাম অনেক বেশি হয়ে যাবে। শখ সবার মধ্যেই থাকে, কিন্তু সবার পক্ষে এতো দাম দিয়ে জুতা কেনা সম্ভব হয় না। তাই আমি নিজেই রঙ বানিয়ে সেগুলো দিয়ে পেইন্ট করি। আমার পেইন্ট করা স্নিকার্সের দাম ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে হয়। কেউ দামী জুতায় রঙ করতে চাইলে তাও করে দেওয়া হয়। মানুষ নিজেদের পায়ে থাকা স্নিকার্সটিকে অন্যদের থেকে বেশি সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে চায়। তাই নান্দনিক একটা ভাব আনতে ডিজাইন করে পরতে চায়।"
পেইন্ট করা স্নিকার্সের স্থায়িত্বকাল টেকসই হলেও, বেশিরভাগ সাদা জুতার ওপর রঙ দিয়ে ডিজাইন করা হয় বিধায়, বিশেষ যত্নের সাথে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। প্রতিবার বাইরে থেকে আসার পর এবং কাদামাটি লাগার পর, জুতা মুছে পরিষ্কার করে রাখলে অনেকদিন পর্যন্ত ডিজাইন ভালো থাকবে। যা পায়ে থাকা স্নিকার্সকে দীর্ঘদিন নতুনের মতো রাখবে।