ভারতবর্ষে পথ্য হিসেবে দেশীয় খাবারেই ভরসা রেখেছিলেন ব্রিটিশরা
১৯ শতকে ভারতবর্ষে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখেই পড়েছিলেন ব্রিটিশরা, কিন্তু সবচেয়ে বড় আপদটা তাদের জন্য ছিল ম্যালেরিয়া। আচমকা উদয় হতো এ রোগ, তারপর দ্রুতই সংক্রমণ ঘটাত চারপাশে।
প্রতিবছর হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ও ব্রিটিশ সেনা ম্যালেরিয়ার কাছে কাবু হতেন। মারাও যেতেন অসংখ্য মানুষ। ম্যালেরিয়ার একটা ঔষধের জন্যে মরিয়া হয়ে ছিলেন ব্রিটিশেরা। শেষতক টোটকা হিসেবে পাওয়া গেল কুইনাইন।
সিনকোনা গাছের ক্বাথ থেকে তৈরি হতো কুইনাইন। ১৮০০-এর দশকের মাঝামাঝি বছরে কয়েক টন করে কুইনাইন ব্রিটিশদের উদরে যেতে লাগল। কিন্তু কথায় আছে, 'কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?'
কুইনাইন বিচ্ছিরিরকমের তেতো স্বাদের। তাই ব্রিটিশ সেনা ও অফিসারেরা কুইনাইন পাউডারকে সোডা ও চিনির সঙ্গে মেশাতে শুরু করলেন। এভাবেই তাদের অজান্তেই জন্ম হলো টনিক ওয়াটারের।
ব্রিটিশরা দেখলেন, টনিক ওয়াটার কেবল ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধেই কার্যকর নয়, পাশাপাশি জিনের সঙ্গেও মেশানো যায় এটি। জিন আর টনিক ওয়াটার তখন এতই জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠেছিল যে, একবার খোদ উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, 'পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল চিকিৎসকদের চেয়েও জিন ও টনিক ওয়াটার বেশি সংখ্যক ইংরেজদের জীবন ও মননকে রক্ষা করেছিল।'
কেবল ম্যালেরিয়া নয়, হরহামেশাই অন্য অনেক রোগের পাল্লায় পড়তে হতো মানুষকে তখন। কেউ কুইনাইন খেয়ে ম্যালেরিয়া সারালেও প্লেগ, কলেরা, অতিসার, অন্ত্রজ্বর, হেপাটাইটিস ইত্যাদি থেকে প্রায়ই রেহাই পাওয়া যেত না।
এসব অসুখবিসুখ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা চেষ্টা ব্রিটিশরা করেছিলেন খাবার ও পানীয় দিয়ে। কলোনিয়াল বিভিন্ন লেখা, চিকিৎসা জার্নাল ও প্যাম্ফলেটে অসুস্থ হলে কী কী খাবার খাওয়া উচিত তার তালিকা দেওয়া থাকত।
এসব খাবারের মধ্যে ছিল ভাত ও যব থেকে বানানো সহজপাচ্য জাউ, দুধভাত, মুরগির ঝোল, ঝাল করে রান্না করা কোয়েল ইত্যাদি। দ্য মেডিকেল গ্যাজেট-এ অতিসারের চিকিৎসায় 'হালকা খাবার' খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ গ্রন্থে সাগুর উপকারিতার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞানী-চিকিৎসক জর্জ ওয়াটও তার আ ডিকশনারি অভ দ্য ইকোনমিক প্রোডাক্টস অভ ইন্ডিয়া (১৮৯৩) গ্রন্থে সাগুর ভেষজ গুণাবলির প্রশংসা করেছেন।
গ্যাস্ট্রিক থেকে বাঁচার জন্য ইউরোপীয় কলোনাইজারেরা ভারতবর্ষের গরমে মাংস কম খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। জ্বর, দুর্বলতার জন্য আদর্শ টোটকা ছিল বিফ টি। এ চা প্রস্তুত করা হতো স্টু করা গরুর মাংসের নির্যাস থেকে।
কলেরার জন্য দ্য সিমেন'স নিউ মেডিকেল গাইড (১৯৪২)-এ পরিস্থিতি বেশি করুণ হলে ব্র্যান্ডি এবং তারপর কিছুটা সুস্থ হলে টোস্ট করা রুটির সঙ্গে আধা গ্লাস মুলড ওয়াইন ও পরে রেড়ির তেল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে কেবল ভূমিতে নয়, উপমহাদেশে আসার সমুদ্রপথও ইউরোপীয়দের জন্য বিপজ্জনক ছিল। মহাসমুদ্রে কয়েক মাসের এ যাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তেন অনেকেই, সেই সঙ্গে মৃত্যুও স্বাভাবিক বিষয় ছিল।
১৯ শতকের শুরুর দিকে বেঙ্গল সার্ভিসের একজন ক্যাপ্টেন টমাস উইলিয়ামসন অভিযোগ করেছিলেন, সমুদ্রে দীর্ঘযাত্রার অন্যতম একটি অসুবিধা ছিল বিষম কোষ্ঠকাঠিন্য। এ সমস্যার সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিকার হিসেবে পরিমিত আহারকে উল্লেখ করেন তিনি। তার পরামর্শ ছিল আলুবোখারা, পাতলা সাগু, বিয়ার ইত্যাদি খাওয়া।
ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে তখন ভেষজগুণসম্পন্ন খাবারদাবার মজুত করা হতো। এসব খাবারের মধ্যে ছিল সাগু, এরারুট, লাইম জুস, শুকনো দুধ, কনডেন্সড দুধ ইত্যাদি। অ্যাংলো সুইস কনডেন্সড মিল্ক তথা মিল্কমেইড ব্রিটিশ জাহাজগুলোর একটি স্থায়ী খাদ্যসামগ্রীতে পরিণত হয়েছিল।
১৯ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানির ক্যানজাত খাবার তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। ওই শতকের শেষের দিকে এসে ক্যানজাত খাবার এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, উপমহাদেশের রান্নাঘরগুলোতে আফিম, কুইনাইন, ক্লোরোডাইন ও ফাওলার'স সল্যুশনের মতো চিকিৎসাবিষয়ক দ্রব্যের পাশাপাশি টিনজাত খাবারও সাধারণ বস্তু হয়ে উঠেছিল।
তখনকার ভারতবাসী ব্রিটিশ গৃহিণীদের রান্নাঘরে এ খাদ্যসামগ্রীগুলো থাকাটাও স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল। ফ্লোরা স্টিণ ও গ্রেস গার্ডিনার দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউজকিপার অ্যান্ড কুক গ্রন্থে লিখেছিলেন, '...মনে রাখবেন, বিশেষ করে ভারতবর্ষে জীবনের অর্ধেক আয়েশ নির্ভর করে পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর, সহজপাচ্য খাবারের ওপর।'
ব্রিটিশ গৃহিণীদের রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করার জন্য তখন অনেক রন্ধনপুস্তকও প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইগুলো মূলত লিখতেন ভারতবর্ষ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থাকা ব্রিটিশ নারীরা। এসব বইয়ে অসুস্থ মানুষদের জন্য কীভাবে পথ্য বানাতে হয়, তার বিবরণ থাকত।
কিছু রেসিপি ছিল জটিল, আবার কিছু বেশ সাধারণ। তবে মেমসাহেবরা এসব রান্নার কাজ তাদের ভারতীয় পাচকদের হাতেই তুলে দিতেন। এভাবে ভারতীয় পাচকরা তৈরি করেছিলেন পিশপাশ নামক একটি খাবার। হালকা, সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর পিশপাশ শিশুদের জন্য বানানো হলেও অসুস্থ মানুষদের খাবার হিসেবেও ব্রিটিশ আমলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ খাবারটি।
খোদ বাংলার প্রথম গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস পিশপাশের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। ১৭৮৪ সালে অসুস্থ অবস্থায় স্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: রাতের খাবার না খেয়েই তিনি ১০টা নাগাদ শুয়ে পড়েছেন। একটু ওয়াইনও ছোঁননি, কেবল জল আর চা পান করেছেন। যদি এতেও কাজ না হয় তাহলে তিনি পিশপাশ, রুটি আর জল খেয়ে থাকবেন…।
২০০ বছরে ব্রিটিশ ও ভারতীয় খাবার রন্ধনপ্রণালী অনেক সময়ই একে অপরের মিশ্রণ নতুন পদের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন রেকর্ড অনুযায়ী, নিত্যদিনের ছোটখাটো দাওয়াই হিসেবে ভাতের মাড় আর কতবেলের শরবতের ওপর দিব্যি ভরসা করতেন ইউরোপীয়ারাও। এছাড়া তাদের চিরতার রস, জোয়ানের পানি ব্যবহারের নজিরও আছে। আবার অনেক ভারতীয় চিকিৎসকও তার স্বদেশী রোগীদের চিকিৎসার সময় পথ্য হিসেবে এরারুটের পুডিং, চিকেন ব্রথ, মাংসের চা ইত্যাদি খেতে বলতেন।