কাগজ আর পেন্সিলে মানুষের অবিকল ছবি আঁকেন যারা
কোলের ওপর রাখা বড় খাতায় পেন্সিলের খোঁচায় একমনে এঁকে চলেছেন বিশ্বনাথ ধর। একটু করে আঁকছেন আর মাথাটা ওপরে হালকা উঠিয়ে চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে বসা ব্যক্তিকে দেখে নিয়ে-আবার মনোযোগ দিয়ে আঁকছেন। এভাবেই চললো টানা ২৫-৩০ মিনিট। তারপর সামনে বসা ব্যক্তিকে ছবিটি দেখিয়ে জানতে চাইলেন তার পছন্দ হয়েছে কিনা। নিজের চেহারার হুবহু একটি স্কেচ দেখে ক্রেতার আসনে বসে থাকা ব্যক্তিটি বেশ উৎসুক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পাওনা মিটিয়ে হাতে থাকা ছবিটি দেখতে দেখতে হেঁটে চলে গেলেন তিনি।
এমন দৃশ্যই দেখা যায় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বইমেলা প্রাঙ্গণে। কয়েকজন শিল্পী একসাথে চেয়ার পেতে বসে পড়েন মেলায় আগতদের মুখাবয়বের ছবি আঁকবেন বলে। সাথে নিয়ে আসেন ডায়মন্ড পেন্সিল আর সাদা কাগজ। ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকেও স্কেচ ছবি এঁকে থাকেন এই শিল্পীরা। তবে সেক্ষেত্রে সরাসরি ছবি আঁকার মতো স্বাচ্ছন্দ্য পান না অনেক শিল্পী।
দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য শিল্পীরা মেলায় তাদের আঁকা স্কেচ ছবিগুলো পাশে দড়ি টানিয়ে ও বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখেন। ছবিগুলো হয় পেন্সিল ও চারকোলে আঁকা স্কেচ। একেকটা স্কেচের আকার অনুযায়ী সম্মানী কতো পড়বে তাও উল্লেখ থাকে। এই শিল্পীদের বেশিরভাগই পুরো বছর জুড়ে ছবি আঁকেন। কারো কারো জন্য ছবি আঁকাই এখন উর্পাজনের মূল পথ।
পেন্সিলে শিল্পীর হাতের জাদু
এতোশতো লোকের মুখাবয়ব আঁকতে হরেক রকমের রঙিন রঙ ও তুলির প্রয়োজন পড়ে না। সাদা কাগজের ওপর কেবল একটি পেন্সিল দিয়েই আঁকা হয় স্কেচগুলো। আর পুরো কাজটিই নির্ভর করে শিল্পীদের দক্ষতার ওপর। পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি তাদের বহু বছরের সাধনার মিশেল একেকটি ছবিতে ফুটে ওঠে।
কেউ নিজের, কেউ বাবা-মার, কেউ সন্তানের, কেউবা আবার প্রিয় মানুষটার স্কেচ আঁকার জন্য আসেন। মেলায় মাসজুড়ে পুরোটা সময় স্কেচ শিল্পীদের একটির পর একটি স্কেচ এঁকে যেতে হয় বিরতিহীনভাবে। কিন্তু মেলা শেষ হয়ে গেলে এই স্কেচ শিল্পীদের দেখা মিলবে কোথায়?
সকাল থেকে একের পর এক স্কেচ করে চলেছেন বিশ্বনাথ ধর বিশু। একটি স্কেচ এঁকে শেষ করার পর তার সাথে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। বললেন, কাজের ফাঁকে তারা শিল্পীরা নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করেন। অনেক শিল্পী বইমেলায় এজন্যেই আসেন, যেন শিল্পীদের সাথে দেখা হওয়ার পাশাপাশি নানা জ্ঞানী-গুনী, দেশ-বিদেশের লোকেদের সাথে দেখা হয়ে যায়।
কথার ফাঁকে ফাঁকে একপাশে বোর্ডে সাটিয়ে রাখা তার আঁকা নামী-দামী অভিনয় শিল্পীদের স্কেচ দেখছিলাম। দেখতে পেলাম বোর্ডের এক কোণে তার ব্যক্তিগত নাম্বার লিখে ক্লিপে আটকে দিয়েছেন। মেলা শেষে যারা যোগাযোগ করতে চান, তাদের সুবিধার জন্য এটা করেছেন বলে জানালেন বিশ্বনাথ।
মেলার সময় ব্যস্ততার চাপে অনেকের ছবি এঁকে শেষ করতে পারেন না। কেউ কেউ চান তোলা ছবি থেকে স্কেচ করাবেন বা নির্দিষ্ট সময় পর মনের মতো স্কেচ করে বিশেষ মুহূর্তে প্রিয়জনদের উপহার দিবেন। সেক্ষেত্রে মেলার পর অনলাইনেও বিশ্বনাথ ধর ছবির অর্ডার নিয়ে থাকেন। ফেসবুকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ক্রেতারা যোগাযোগ করে অর্ডার দিয়ে থাকেন। কেউ চাইলে মোবাইলেও অর্ডার করতে পারবেন।
স্কেচ শিল্পী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে বিশ্বনাথ ধর বললেন, "ছোটবেলায় শখ থেকে ছবি আঁকা-আঁকি করতাম। নায়ক-নায়িকাদের ছবির পোস্টার কিনে সেগুলো দেখে দেখে আঁকতাম। এভাবে মানুষের ছবি আঁকা আমার নেশার মতো হয়ে গেল। সেখান থেকে পেশা হিসেবে সিনেমার পোস্টার ডিজাইন শুরু। আলমগীর, সাবানার সিনেমা থেকে শুরু করে বহু পোস্টার আমার নিজের হাতে করা।"
"আমাদের সময় ডিজিটাল পদ্ধতিতে পোস্টার বানানোর চল ছিলো না। ঐগুলো হাতে এঁকে, রঙ করে বানানো হতো। পত্রিকার বিজ্ঞাপন, ভিউ কার্ড করতাম হাতে এঁকে। এখন স্কেচ করার পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ ও বাচ্চাদের বইয়ের পাতায় ছবি আঁকি। আমার কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্টুডিও না থাকায় বাসায় বসে কাজ করি। ক্রেতারা তাদের ছবি অনলাইনে পাঠিয়ে দেন, সেগুলো থেকেই স্কেচ করা হয়।"
২৫ বছরের পেশাজীবন বিশ্বনাথের। এ বছর বেশ ভালো ছবির অর্ডার পেয়েছেন বলে জানালেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় ১২-১৫ টা স্কেচ তিনি আঁকেন।
একেকটি স্কেচের দাম কেমন পড়ে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, "যদিও আমরা বলি সরাসরি স্কেচ করতে ২০ মিনিট লাগে, আসলে ভালভাবে কাজটি করতে একজন শিল্পীর কম করে হলেও ২৫-৩০ মিনিটের মতো লেগে যায়। কারো ক্ষেত্রে সময়টা কম বেশি হতে পারে দক্ষতা ও পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে। প্রতিটি ছোট আকারের ছবির জন্য ৫০০ টাকা রাখা হয়, মাঝারি ৭০০ আর বড় সাইজের ছবি ১ হাজার টাকা। তবে দামের পরিবর্তন হতে পারে ছবির ধরন ও পরিশ্রমের ওপর। যেমন দুজন ব্যক্তির স্কেচ এক পাতায় করতে গেলে পরিশ্রম আর সময় বেশী লাগবে, সেক্ষেত্রে দাম বেড়ে যাবে।"
তারমতোই আরেকজন নাটুরাজ সজল। ছোট থেকেই শখের বশে ছবি আঁকতেন। সেখান থেকে আজ তিনি পেশাগত একজন শিল্পী। প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ বছরের একটি কোর্স করেছেন ছবি আঁকার ওপর। পেন্সিল স্কেচ, রঙিন স্কেচ, পেইন্টিং, চারকোল সবকিছু দিয়েই তিনি ছবি আঁকেন। এমনকি ঢাকার মধ্যে ক্রেতাদের ঠিকানায় ২০০ টাকা ডেলভারি চার্জের বিনিময়ে ছবিগুলো পৌঁছে দেন নিজ দায়িত্বে। পরিবার উৎসাহ দেওয়ায় তিনি তার শখের কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পেরেছেন।
পাশেই কান্তি সরকার নামের একজন শিল্পীকে মোবাইল হাতে নিয়ে একটি স্কেচ ছবি আঁকতে দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। তার সামনে চেয়ারে বসে ছিলেন এক তরুণ। নাম উহ্য রেখে তরুণ এই ক্রেতা জানালেন, স্কেচ আঁকা ছবিটি তার প্রেয়িসীর। লন্ডন থেকে কিছুদিন পরে তার প্রেমিকা দেশে আসবেন, তাকে উপহার দিতেই তিনি এই স্কেচ বানিয়ে রাখছেন। তিনি নিজের ছবিসহ পরিবারের আরও ২ জনের স্কেচ আঁকিয়েছেন শিল্পী কান্তি সরকারের কাছ থেকে।
কান্তি সরকার ছবি আঁকেন চারকোলে। তিনি বলেন, "আমি চারকোল দিয়ে আঁকতে বেশি স্বাচ্ছ্যন্দ্যবোধ করি, তাই সবসময় এটা দিয়েই আঁকি। স্বল্প দামে ছবি আঁকি শখের কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতে। ক্রেতারাও এতে খুশি হোন, আর আমিও কাজটা করি আনন্দের সাথে। আমরা যে কাজটা করছি এটা একটা শিল্প। আর শিল্পের কোনো মূল্য হয় না। যা নেওয়া হয় তা কেবল নামমাত্র একটা পারিশ্রমিক বলা চলে।" বইমেলা বাদে অন্যান্য সময় তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ, লোগো, ডিজাইন ও ইলাস্ট্রেশনের কাজ করে থাকেন।
শিল্পীরা জানান, বইমেলার একমাসে তাদের ছবি বাবদ পারিশ্রমিক হিসেবে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়ে থাকে। তাই আনন্দের পাশাপাশি পেশা হিসেবে ছবি আঁকাকে তারা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন। প্রবীণ এই শিল্পীদের মতো অনেক তরুণ শিল্পীরাও তাদের শখের ছবি আঁকার নেশাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
সায়মা হক একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। তার ৬ বছরের সন্তানকে ঘুরতে নিয়ে এসেছেন। মা ছেলের একত্রে অনেক ছবি তোলা হলেও স্কেচ নেই। সায়মা হক ছবির দামের চেয়ে শিল্পীর প্রতিভা কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, "আমি চাইলেও এমন একটি ছবি আঁকতে পারবো না। তাই এটির মূল্য টাকার অঙ্কের চেয়ে অবশ্যই বেশি।"
"শিল্পীরা তাদের মেধা আর পরিশ্রম দুটোই এখানে দিচ্ছেন। বাড়িতে আমার অনেক ছবিই দেয়ালে ফ্রেমে সাজিয়ে রাখা আছে। তবে আমার কাছে মনে হয় হাতে আঁকা ছবির মধ্যে একটা অন্যরকম ভালো লাগা আর আকর্ষণ কাজ করে।"