ভারতের হীরা শিল্পে যেভাবে বিপ্লব ঘটছে
চিন্তন সুহাগিয়ার বয়স মাত্র ২৬, কিন্তু এই বয়সেই ভারতের হীরা শিল্পের সাথে সাত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে তার। হীরা পালিশ করার রাজধানী হিসেবে পরিচিত পশ্চিম ভারতের সুরাটে তার কোম্পানি। শুরুটা হয়েছিল কোম্পানির হয়ে বিভিন্ন জায়গায় হীরা সরবরাহের মাধ্যমে। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি কীভাবে হীরার মান যাচাই করতে হয়, যাচাই করার জন্য বিশেষ যন্ত্রের ব্যবহারগুলোও শিখে নিয়েছেন।
ভারতীয় হীরা শিল্পে এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটার পর তার ক্যারিয়ারের গতি পাল্টে যায়। দুই বছর আগেও সুহাগিয়া যে হীরাগুলো পরীক্ষা করতেন তার সবগুলোই ছিল প্রাকৃতিক, যেগুলো খনি থেকে খনন করে তুলে আনা হতো।
তবে এখন তিনি কাজ করেন বিশেষ ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত হওয়া হীরা নিয়ে, যেগুলো দশ বছর আগেও তেমন একটা পাওয়া যেত না। গত দশকের প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে কৃত্রিম হীরার এই খাতে দারুণ বিকাশ দেখা গিয়েছে।
ল্যাব-গ্রৌন ডায়ামন্ড বা এলজিডি নামে পরিচিত এই হীরাগুলো এতটাই প্রাকৃতিক হীরার মতো দেখতে যে বিশেষজ্ঞদেরও খুব ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে হয়। সুহাগিয়ার মতে, "খালি চোখে কোনোভাবেই কেউ প্রাকৃতিক আর এলজিডির পার্থক্য ধরতে পারবে না।"
তিনি জানান, "প্রাকৃতিক হীরা আর ল্যাব-গ্রৌন হীরাগুলো এতটাই কাছাকাছি যে ল্যাব টেস্ট করার পরও সন্দেহ থেকে যায় এটি প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম। প্রতিটি হীরাকে দুইবার টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হয় এর উৎপত্তি সম্পর্কে।"
ভূগর্ভে প্রচণ্ড চাপ আর তাপে প্রাকৃতিক হীরা তৈরি হয়। পঞ্চাশের দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা মাটির ওপরেই একই উপায়ে হীরা তৈরির চেষ্টা করছেন। দুইটি উপায়ে এটি করা হয়।
এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হলো হাই প্রেশার হাই টেম্পারেচার (এইচপিএইচটি) প্রক্রিয়া, যেখানে খুবই ছোট এক টুকরো হীরার চারপাশ খাদহীন গ্রাফাইট (এক ধরনের কার্বন) দিয়ে মুড়ে দিয়ে সেটিকে একটি চেম্বারে রাখা হয়। চেম্বারটি দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে রেখে প্রতি বর্গইঞ্চিতে দেড় মিলিয়ন পাউন্ড চাপ প্রয়োগ করা হয়। তৈরি হয়ে যায় হীরা!
দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি হলো কেমিক্যাল ভ্যাপার ডিপোজিশন (সিভিডি) প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ডায়ামন্ড সিডটিকে একটি ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার চেম্বারে রেখে সেখানে কার্বন গ্যাস ঢোকানো হয়। হীরার টুকরোটির ওপর এরপর গ্যাসের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে হীরা তৈরি হয়।
বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই দুটো প্রক্রিয়াই আবিষ্কার হলেও সঠিক দামে উৎপাদন এবং অলঙ্কার হিসেবে বিক্রির জন্য সময় লেগে যায় গত দশক পর্যন্ত। এই সময়েই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরো উন্নত করা হয়।
প্রাকৃতিক হীরা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেইন অ্যান্ড কোম্পানির জুরিখভিত্তিক সহযোগী ওলিয়া লিন্ডা জানান, "প্রথমদিকে কৃত্রিম উপায়ে হীরা উৎপাদন খুবই কঠিন ছিল। মেশিন ছিল কম, খুব কম বিজ্ঞানীই ছিল যারা এটি করতে দক্ষ। গত সাত বছরে বাজারে এ বিষয়ে আরো দক্ষ লোক তৈরি হয়েছে, প্রযুক্তিও উন্নত হয়েছে। আমরা এই কৃত্রিম হীরা খাতে বিশাল বিকাশ দেখছি।"
লিন্ডা জানান ২০০০-এর দশকের পর থেকে ল্যাব-গ্রৌন হীরাগুলো উৎপাদনের খরচ প্রতি চার বছর অন্তর অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে এনগেজমেন্ট আংটির জন্য পরিচিত এক ক্যারাটের এলজিডি তৈরি করতে খরচ পড়বে এর প্রাকৃতিক সংস্করণের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। হীরার দাম পড়ে যাওয়ায় এর প্রতি অনেক বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হচ্ছেন।
২০১৩ সালে ভান্ডেরি ল্যাব গ্রৌন ডায়ামন্ডস নামের প্রতিষ্ঠান খোলেন স্নেহাল দুঙ্গার্নি। তার কারখানায় সিভিডি প্রক্রিয়ায় হীরা উৎপাদন করা হয়।
"আমরা হীরা উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখতে পারি, প্রতিটি পরমাণু আমাদের চোখের সামনে যোগ হয়। একেবারেই নিখুঁত খাদহীন হীরা উৎপাদন করা যায় এর মাধ্যমে। তুলনা করলে এটি উৎপাদন করতে খরচ কম লাগে, সময়ও কম লাগে। তাছাড়া এর ফলে মাইনিং আর এক্সট্র্যাকশন খরচও বেঁচে যায়, যা মানুষ আর পরিবেশ দুইয়ের জন্যই ভালো।"
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই হীরা শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পৃথিবীর প্রতিটি ১০টি হীরার ৯টিই সুরাটে পালিশ করা হয়। এখন দেশটির সরকারও চাইছে ল্যাব গ্রৌন ডায়ামন্ডের ক্ষেত্রেও ভারত প্রধান ভূমিকা পালন করুক।
ইতিমধ্যেই বছরে ৩০ লক্ষ ল্যাব-গ্রৌন ডায়ামন্ড উৎপাদন করে দেশটি, যেটি বৈশ্বিক উৎপাদনের ১৫ শতাংশ।একই ধরনের মার্কেট শেয়ার নিয়ে চীনও আরেকটি বড় উৎপাদনকারী।
এই খাতকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত সরকার আমদানি করা ডায়ামন্ড সিডের ওপর ৫% শতাংশ কর বাতিল করেছে এবং ভারতেই ডায়ামন্ড সিড উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিপুল বানসাল জানান, "বৈশ্বিক বাণিজ্য বাড়ার সাথে সাথে হীরার চাহিদাও বাড়বে।"
হীরা নিয়ে ৩০ বছর ধরে কাজ করা হরি কৃষ্ণ এক্সপোর্টস বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান যারা হীরা কাটা এবং পালিশ করার সাথে জড়িত। তবে এই বছরেই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ঘনশ্যামভাই ধোলাকিয়া ল্যাব গ্রৌন ডায়ামন্ড ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। তিনি জানান, "আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ল্যাবে তৈরি হীরার ব্যাপক চাহিদা দেখা যাবে।"
তবে ল্যাবে উৎপাদিত হীরা কি প্রাকৃতিক হীরাকে বাজার থেকে সরিয়ে দিতে পারবে?
ধোলাকিয়ার মতে, "প্রাকৃতিক আর ল্যাবে উৎপাদিত হীরার দুই ধরনের ভোক্তা রয়েছে। এবং দুই বাজারেই চাহিদা বাড়ছে। এলজিডি হীরা এক নতুন ভোক্তাসমাজ তৈরি করেছে, আর তা হলো ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজ, যাদের কাছে ল্যাবে তৈরি হীরা কেনার মতো যথেষ্ট টাকা রয়েছে।"
তবে ভারতের বাজারে এলজিডি স্বাভাবিক পণ্য হতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ বর্তমানে ভারতে উৎপাদিত বেশিরভাগ এলজিডি-ই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
ল্যাব গ্রৌন ডায়ামন্ড অ্যান্ড জুয়েলারি প্রমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শশীকান্ত ডালিচাঁদ শাহ জানান, "ভারতীয় বাজার এখনো প্রস্তুত নয়, তাই আমাদের কাউন্সিল এখন এটি প্রচারের জন্য বিভিন্ন প্রদর্শনী ও ইভেন্টের আয়োজন করছে। আর তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই ভারত প্রস্তুত হয়ে যাবে।"
দাদার বাবার হাতে প্রতিষ্ঠিত হীরা বাণিজ্যকারক প্রতিষ্ঠান নাইন ডিয়ামের বর্তমান চেয়ারম্যান শশীকান্ত শাহ। তার মতে, কৃত্রিম হীরা আর প্রাকৃতিক হীরার বাজার আলাদা হবে। "কারখানায় বা ল্যাবে উৎপাদিত হীরা হলো কৃত্রিম হীরা। তাই একজন ভোক্তা যিনি হীরা ভালোবাসেন, তিনি আসল হীরাই কিনতে চাইবেন।"
তাছাড়া প্রাকৃতিক হীরা বিরল হওয়ায় সেগুলো তাদের দাম ধরে রাখবে বলেই মনে করেন তিনি।
ল্যাব-গ্রৌন হীরাগুলো কেনার পর তার দাম হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক হীরার ক্ষেত্রে কেনার পরও তার ৫০% দামে বিক্রি করা যায়।
তবে দাম যা-ই হোক না কেন, অলঙ্কার ডিজাইনারদের জন্য দারুণ সুবিধা বয়ে আনে কৃত্রিম হীরাগুলো।
লিন্ডা জানান, "প্রাকৃতিক হীরার দাম এতটাই বেশি যে এর সর্বোচ্চটুকুই রেখে দিতে চাইবেন আপনি। কিন্তু ল্যাবে উৎপাদিত হীরার ক্ষেত্রে এই বাঁধাধরা নেই, আপনি আপনার ইচ্ছামতো ডিজাইন করতে পারবেন। আমি এমন হীরাও দেখেছি যার মাঝখান থেকে ফুটো করা হয়, যাতে সেগুলো আরো জ্বলজ্বল করে।"
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অলঙ্কার তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান ডেনমার্কের প্যান্ডোরা প্রাকৃতিক হীরা বাদ দিয়ে ল্যাব-গ্রৌন ডায়ামন্ড দিয়ে অলঙ্কার তৈরি শুরু করেছে। ২০২১ সালে তাদের এই পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বলেন যে এর ফলে তারা হীরার বাজার আরো বড়, আরো উন্মুক্ত করতে চাইছেন এবং একইসাথে তার ব্যবসাটিকে আরো পরিবেশবান্ধব করতে চাইছেন।
সুরাটে থাকা চিন্তন সুহাগিয়া এলজিডি শিল্পে সরে আসার জন্য খুশি এবং তিনি মনে করছেন আরো অনেকেই এই খাতে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসবে। তিনি জানান, "ল্যাব-গ্রৌন ডায়ামন্ড শিল্প কয়েক লক্ষ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এটা একটি অপ্রতিরোধ্য খাত হয়ে উঠবে।"
সূত্র: বিবিসি