থানায় লাইব্রেরি: বই দিয়ে সম্পর্ক গড়া
পুলিশ স্টেশনের কথা ভাবলেই আমাদের মনে সাধারণত ভীতিকর কোনো জায়গার কথা মনে আসে। কারণ দাগি আসামিদের গ্রেপ্তার করার পর তো এখানেই নিয়ে আসা হয়।
তবে পুলিশের আসল কাজ কিন্তু সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সেবা করা। সে কথা মাথায় রেখেই সমাজসেবার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী, শিশু, ছেলেশিশু ও প্রতিবন্ধী হেল্প ডেস্কের অংশ হিসেবে রিডিং কর্নার বা ছোট লাইব্রেরি স্থাপনের এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়েছে রাজধানীর দুটি থানা (কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগ। সংগঠনটি.
ভুক্তভোগী ও অন্য যারা আসে থানায় আসে, তারা অপেক্ষা করার সময় এখান থেকে বই পড়তে পারে।
কামরাঙ্গীরচর থানা চত্বরে প্রবেশ করলেই দেখবেন ছোট একটি পথ চলে গেছে মূল ভবনে। নিচতলায় প্রথম কক্ষটিই হেল্প ডেস্ক। সাধারণত একজন নারী সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) ভুক্তভোগীদের প্রাথমিক সহায়তা দেওয়ার জন্য এখানে বসেন। ওই ঘরেই বইসহ দুটি কাঠের শেলফ ও একটি ছোট পড়ার টেবিল এবং কয়েকটি চেয়ার রয়েছে।
শেলফগুলোতে হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় লেখকের কথাসাহিত্য যেমন আছে, তেমনি আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'কারাগারের রোজনামচা' ও 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র মতো আরও কিছু ঐতিহাসিক বই।
আমাদের স্বাগত জানালেন কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানালেন, গ্রন্থাগারটি ছোট পরিসরে করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিসর আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
মোস্তাফিজুর বলেন, লাইব্রেরি স্থাপনের বুদ্ধিটি এসেছিল অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নিশাত রহমান মিঠুনের মাথা থেকে। তিনি বর্তমানে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন।
'জানেনই তো, কামরাঙ্গীরচর একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আর আমাদের স্টেশনে প্রতিনিয়ত লোকজন আসে। কখনও কখনও অভিযোগ দায়ের করার আগে তাদের খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়,' মোস্তাফিজুর বললেন। 'উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা না করে তারা লাইব্রেরিতে বসে বইপত্র পড়তে পারে।'
তিনি বলেন, 'ছোটবেলায় পুলিশ অফিসার দেখলে আমরাও ভয়ে দৌড়ে পালাতাম। এখন এমনটা দেখা যায় না। মানুষ জানে, পুলিশ তাদের সাহায্য করার জন্য আছে। এখানে সব বয়সি পাঠকরা বই পড়তে আসে। আর এই বিষয়টা আমাদেরও ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমাদের অফিসাররাও বই পড়েন।'
মোস্তাফিজুর রহমান আরও জানালেন, পাঠকরা চাইলে বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কে কোন বই নিল, তার হিসাব রাখার জন্য রেজিস্টার বইও আছে। মানুষ চাইলে লাইব্রেরিতে বই দানও করতে পারে। লাইব্রেরিটিতে কিছু বই অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা দিয়েছেন। এছাড়া এলাকার একটি স্কুলও তাদের কিছু বই দিয়েছে বলে জানান মোস্তাফিজুর।
'[পুলিশ স্টেশন] বড় কমপ্লেক্সে স্থানান্তরিত হওয়ার পর আমরা একটা বড় এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তুলতে কাজ করব,' বলেন তিনি।
লালবাগ থানার ওসি কর্মস্থলে ছিলেন না, তাই আমরা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) মো. আনিসুর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানালেন, তাদের লাইব্রেরিও সবার জন্য উন্মুক্ত এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে এতে ভালো সাড়াও পাওয়া গেছে।
'এটি ভালো উদ্যোগ, আমাদের সবাই-ই উদ্যোগটার প্রশংসা করেছেন। একটি থানায় লাইব্রেরি থাকলে শুধু যে উপকার হবে, তা নয়; এটি পুলিশ বাহিনীর আরও ইতিবাচক ভাবমূর্তিও তুলে ধরছে,' বলেন তিনি।
নবনির্মিত লালবাগ থানা হেল্প ডেস্ক ও লাইব্রেরির জন্য দোতলায় একটি ছোট কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একপাসের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটি বড় শেলফে লিগ্যাল হেল্প গাইডসহ কিছু রাখা। ধুলোর পাতলা আস্তর পড়েছে বইগুলোর ওপর।
এই লাইব্রেরিটি কামরাঙ্গীরচরের চেয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। হেল্প ডেস্কের দায়িত্বে থাকা এসআই মুক্তি দত্ত অমা আমাদের জানালেন, বাইরের পাঠকরা এখনও বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন না। এছাড়া এখনও মানুষের কাছ থেকে বই অনুদান নেওয়ার কথাও ভাবেননি তারা। মুক্তি জানালেন, কাজের চাপ কম থাকলে মাঝে মাঝে তিনি বসে বসে বই পড়েন।
থানা দুটিতে রিডিং কর্নারগুলো পরিদর্শনের সময় বইয়ের পরিমাণ ও ছোট পরিসর দেখে খুব একটা মুগ্ধ হতে পারিনি। পাঠকও তেমন ছিল না।
তবে এ ধরনের উদ্যোগগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়। থানায় কেউ পূর্ণাঙ্গ লাইব্রেরি আশা না করলেও বেশ কিছু বইয়ের সংগ্রহ থাকলে ভালো আবহ তৈরি করে, পুলিশের ভাবমূর্তিও ভালো দেখায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব থানায় এই উদ্যোগ নিলে এবং বইয়ের সংখ্যা বাড়ালে খুব ভালো হয়।
এই থানা দুটির ছাড়াও কমলাপুরে ঢাকা রেলওয়ে থানায় আরেকটি রিডিং কর্নার আছে। তবে এখানকার রিডিং কর্নারটি হাজতের (ডিটেনশন সেল) ভেতরে নির্মিত। হাজতিদের সাহায্য করার জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত হয়েছে এটি।
সম্প্রতি খুলশী, কোতোয়ালি ও ডবলমুরিংসহ ছয়টি থানায় লাইব্রেরি স্থাপন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। সিএমপির সাবেক কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এই উদ্যোগ নিয়েছেন।
এই লাইব্রেরিগুলোতে কবিতা, ক্রাইম ফিকশন, আইন, মুক্তিযুদ্ধ ও পুলিশিংসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৩০০ থেকে ৬০০ বই আছে। সিএমপি কর্তৃপক্ষ তাদের আওতাধীন অন্যান্য থানায় আরও ১৬টি লাইব্রেরি নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
দেশের পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যকার সম্পর্ক বরাবরই কিছুটা ভয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষ এই দূরত্ব দূর করার এবং পুলিশের সাহায্যপ্রবণ প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে চলেছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এই লাইব্রেরিগুলো সাধারণ মানুষের মনে পুলিশ সম্পর্কে আরও ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে থাকবে বলে আশা করা যায়।